তোমারে ভুলেছি আজ-
সারাদিন বসি’ তোমারে ভাবিব, ভারি ত প’ড়েছে কাজ!
সকালে উঠিয়া বেড়াইতে যাই, নদীটির তীরে যাই-
সেইখানে তুমি নিতুই আসিতে, হাসি যে থামে না ছাই!
সেই কবে তুমি রাঙা পাও মেলে এসেছিলে নদীতীরে;
সে পায়ের রেখা কবে মুছে গেছে ভরা বরষার নীরে;
সেথা যে এখন ঘন কাশবন, তুমি ভাবিয়াছ বুঝি,
সেই কাশবন দুহাতে সরায়ে তব পা’র রেখা খুজি।
বালাই প’ড়েছে, আমি সেথা রোজ এমনি বেড়াতে আসি,
কাশের পাতায় শিশির জড়ান, তাতে রোদ যায় ভাসি।
প্রথম রবির সিঁদূরিয়া রোদ, তোমার রঙীন ঠোঁটে,
কতদিন আমি দেখেছি ওমনি রাঙা রাঙা হাসি ফোটে।
তাই ব’লে আমি তোমারে ভাবিনে, কাশের ক্ষেতের পরে
কাঁচা-পাকা ধান অঝোরে ঘুমায় দেখিও স্মরণ ক’রে।
সারারাত তারা স্বপন দেখেছ, জোছনায় গাও মেলি’
বক্ষে তাদের রাতের শিশির স্বেচ্ছায় গেছে খেলি।
তোমারি গায়ের রঙখানি যেন সেই ধানক্ষেতে পাতা;
তাই বুঝি আমি সেইখানে যাই? এমনি হয়েছি যা-তা!
সেইখানে বসি’ দুধালি লতায় কলমীর ফুল বাঁধি
আজো মনে আছে, কবে দিয়েছিনু তোমার গলায় সাধি!
আজো মনে আছে- সেই কবে তুমি মঞ্জরী-ধান তুলি,
কানে পরেছিলে হাতে বেঁধেছিলে দু-একটি তার ভুলি!
আজো কি আমার স্মরণে রয়েছে বলেছিনু সেই কবে,
‘এমন সাঁঝেতে যে দেখিবে তোমা, কৃষাণের রাণী কবে।’
ভুল- ভুল সখি, ও সব ভাবার অবসর নাহি আর,
পারিনে এখন সময় কাটাতে কথা লয়ে যার-তার,
বিকালে কেবল বেড়াইতে যাই- নদীর তীরেই যাই,
সেখানেতে বুঝি তুমি ছাড়া আর কেহ কভু আসে নাই?
সেই পথ দিয়ে কত লোক চলে- সেই চলা-পথ ধ’রে,
চলে মহাকাল দিন-রজনীর আলো-ছায়া পাখা ভরে।
চলে কত রবি, চলে কত চাঁদ- চলে শত গ্রহ তারা,
রেখা-লেখাহীন অনামিক পথে হইয়া আপনহারা।
দিন-বলাকার বলয় ঘিরিয়া নির্মম পথ-নাগ,
ঘুমায়েছে আজো- গাঁয়ে পরিল না কাহারো পায়ের দাগ।
সেই পথ দিয়ে তুমি এসেছিলে, ফুলতনু রথখানি
উড়ায়ে যাইতে ভাবিয়াছ সেথা গেছ ফুলরেখা টানি’!
ভাবিয়াছ, তব গায়ের গন্ধ উড়েছিল বায়ুভরে;
সবটুকু তার রাখিয়াছি আমি বুকের আঁচলে ধরে।
-আজো সে গন্ধ ছড়াইয়া দিয়ে সাঁঝের উতল বায়
এই বালুচরে একেলা আমার সময় কাটিয়া যায়!
মিথ্যা সজনী- মিথ্যা এ সব, নিজেরেই লয়ে মরি,
নিজেরেই মোর সামলান দায় পরেরে কখন্ স্মরি?
দূর পশ্চিম গগনের কোলে নানান মেঘের মেলা
তারি ‘পরে বসে নানান বরণ রৌদ্রের হাসিখেলা,
সে হাসি আবার ঝরিয়া পড়েছে কতক নদীর জলে,
নদী ও আকাশ লালে লাল হাসে ধরিয়া এ-ওর গলে।
তুমি ভাবিয়াছ সেথায় পাতিয়া রঙের ইন্দ্রজাল,
তোমারে ধরিতে রোজ সন্ধ্যায় একেলা কাটাই কাল।
তুমি বুঝি ভাব ওই যেখানেতে দুলিতেছে ঝাউবন,
সেখানে বসিয়া কত কি ভাবিয়া কাঁদি আমি সারা খন।
আমি বুঝি ভাবি সেই কবে তুমি ধরিয়া আমার কর
বলেছিলে, “এই ভালবাসা মোরা রাখিব জনম ভর।”
কাশের পাতায় মোর হাতখানি বাঁধিয়া তোমার হাতে
“এই বন্ধন অটুট রহিবে” বলেছিলে নিরালাতে।
আরো বলেছিলে, “এই কাশপাতা যদি-বা ছিঁড়িয়া যায়
মনের বাঁধন মনেই রহিল টুটিতে দেব না তায়।”
আমি বলেছিনু,- “সোনার বন্ধু, বড় ভয় করে মোর
প্রণয়ের রাতি ঘুম না ভাঙিতে হয়ে যায় যে গো ভোর।
শিয়রে প্রদীপ জ্বলিতেই থাকে, রজনী যে হয় বাসি,
এদেশে যে সখি বাসরের রাতে বাজে বিদায়ের বাঁশী।”
তুমি বলেছিলে, “যদি-বা কখনো রজনী পোহাতে চায়
এ দুটি কোমল বাহুর বাঁধনে ফিরায়ে আনিব তায়।
আমি কয়েছিনু, “শোন গো সজনী, কাঁদে মোর ভীরু হিয়া,
বড় ভয় করে যদি বা তোমারে আর কেহ যায় নিয়া।
পদে পদে মোর কত অপরাধ, হয় ত মনের ভুলে
যদি কোনদিন এ ফুলতনুতে কোনো ব্যথা দিই তুলে,
তখন কি তুমি মোরে ছেড়ে যাবে? শোন ওগো মনোরমা,
সেদিনের সেই অপরাধ হ’তে করিবে আমারে ক্ষমা?
তুমি সুন্দর, জগত জুড়িয়া পূজামন্দির পাতি’
মন্ত্রে মন্ত্রে ডাকিতেছে তোমা পূজারীরা দিবারাতি।
মোর এই গেহে ক্ষুদ্রের পূজা, বাতাসে ভাসিয়া হায়,
যদি কোনোদিন আর কোনো গান লাগে এসে তব গায়,
এ মোর গেহের নানান ছিদ্র যদি তারি পথ বেয়ে
আর কোনো কানো গান ভেসে আসে কাহার প্রণয়ে নেয়ে?
তখন কি তুমি মোরে ছেড়ে যাবে?” তুমি বলেছিলে হায়,
অলীক ভয়ের দেউল গাঁথিয়া ঠকায়ো না আপনায়।
তোমার ঘরের যত ফাঁক আমি বুকের আঁচল চিরে
এমনি করিয়া বাঁধিয়া রাখিব মায়ামমতায় ঘিরে!
আর কারো গান পশিবে না হেথা, শুধু তুমি আর আমি,
তার সাথে সাথে রহিবে সাক্ষ্য দীর্ঘ দিবস যামী।
তুমি ভাবিয়াছ সেদিনের সেই তরুণ তৃণের মাঠ
এই-সব কথা বক্ষে লিখিয়া আজিও করিছে পাঠ!
সেদিনের সেই শুক্নো নদীরে সাক্ষ্য মানিয়া হায়,
এমনি যে সব শুনেছিনু কথা বসিয়া তোমার ঠাঁয়।
-আজিকার নদী সে নদী ত নাই, যদিও বরষা শেষ
তবু এর বুকে লেখা নেই সখি সে সবের কোনো লেশ।
সেদিনও এমনি দুলেছিল সখি শূন্যের নীল মায়া,
-তব এ আকাশ সে আকাশ নয়, এর বুকে মেঘছায়া।
সেদিনও এমনি বিভোল বাতাস,- আজিকার মত নয়
এ যেন কি ব্যথা সহিতে না পেরে কঁদিছে ভুবনময়।
এই বালুচর,- একি সেদিনের? হায় হায় সখি হায়,
কি ব্যথারে এ যে গুড়ো করে আজি উড়িছে উতল বায়।
এরা কেউ তার সাক্ষ্য হবে না- নাই তার প্রয়োজন
তুমি যদি মোরে ভুলে গেলে সখি, মোর ভোলা কতখন।
তোমারে স্মরিয়া কাঁদিতেছি আমি, চোখে পোকা লাগিয়াছে
তাই এত জল, প্রত্যয় নাহি শুধাও না কারো কাছে?
ফুলে পোকা লাগে, বুকে পোকা লাগে- লাগে ভালবাসা মাঝে,
এ তবে এমন বিস্ময় কিবা চোখে যদি পোকা রাজে?
তোমারে আজিকে ভুলে গেছি আমি, বক্ষে নখর হানি’
ভাবিতেছি হায় হেঁড়া যায় নাকি ব্যথাভরা মনখানি!
সারা দেহে আমি বালু মাখিতেছি, বালুর কঠোর ঘায়,
দেখি যদি এই জীবন হইতে কারো স্মৃতি মোছা যায়।
রাতের কালিরে মুঠি মুঠি ধরে সারা গায়ে বসে মাখি,
মনে হয় এরি কুহেলী মায়ায় বেদনারে ঘিরে রাখি।
তুমি ভাবিয়াছ তোমারে ভাবিয়া রাতে ঘুম নাই মোর,
শিয়রে প্রদীপ জ্বলিতেই থাকে আমার হয় না ভোর!
মিথ্যা এসব- কলাবন ধরি রাতের বাতাস কাঁদে,
বাঁকাচাঁদ তারে ধরিবারে চায় জোছনার মায়া ফাঁদে।
রাতের বিরহী ঝিঁঝিরা বাজায় বে-ঘুম বুকের কথা,
তারি সাথে যেন ডাক ছেড়ে কাঁদে- এ মূক মাটির ব্যথা!
তারি সাথে সাথে গান ভেসে আসে কবরের মাটি ফোঁড়ি,
সেই সুরে সুরে আমিও আমার বুকের ব্যথারে ছাড়ি।
এই ধরণীর কঠোর মাটির মহা-ভার বুকে নিয়ে,
অনন্তকাল এ মাটির সনে কেঁদেছে যাদের হিয়ে
সেই সব মৃত সাথীদের সনে গলাগলি ধরি রোজ,
আরো অভিনব তীব্র ব্যথার একা আমি করি খোঁজ!
তাই রাত কাটে! আমি আছি আর আছে মোর এই ব্যথা
নাই- নাই আর অবসর নাই, ভাবিতে কাহারো কথা।
চিঠিগুলি তব বাক্সে ভরেছি। আঁটিয়াছি চাবি তালা,
তবু ভয় হয় পাছে বা তাহারা খুলে বাহিরায় ডালা।
বারে বারে তাই খুলে খুলে দেখি পড়ে দেখি বার বার
যদি কোনো কথা কোনো ফাঁক দিয়ে হয়ে আসে কভু বার,
কাপড় জড়ায়ে বাক্সেরে ঢাকি যদি তারা কোনো ফাঁকে
ভালবাসি আমি, হেন কোনো কথা মনে এসে রেখা আঁকে!
তুমি লিখেছিলে, চিঠির আখরে তুমি লিখেছিলে মোরে,
“পরাণবন্ধু, তোমানো ব্যথায় আমার পরাণ ঝরে।”
আরও লিখেছিলে, “তুমি যদি সখা আমারে স্মরণ করি
এমনি করিয়া কাঁদিয়া কাটাও সারাটি জনম ভরি।
তোমার গেহেতে যে প্রদীপ আজি জাগিয়া কাটায় রাতি
তারে ব’লে দিও মোর গেহে হেন জ্বলিছে বে-ঘুম বাতি।
আরও লিখেছিলে, “যে প্রদীপ আজি বুকের ব্যথারে জ্বালি’
তিলে তিলে হায় নিজেরে ধরিয়া আগুনে দিতেছে ঢালি’!
তার জালা দেখে পতঙ্গ সেও মরণ বরণ করে,
আমি ত মানুষ, তোমার ব্যথায় কি করে রহিব ঘরে!
আমি ভাবিতেছি এই-সব কথা যদি আজ পাখা মেলি’
বাক্সের কোনো ছিদ্র বাহিয়া বাহিরেতে আসে ঠেলি!
-তাই বারে বারে তালা চাবি দিয়ে বেঁধেছি বাক্সটারে
এর কোনো কথা আর যেন কভু বাহিরে আসিতে নারে।
খুলিয়া খুলিয়া চিঠিগুলি পড়ি, যদি বা হঠাৎ করে,
এ সব কথার এক আধটি বা উড়ে যায় হাওয়াভরে!
তাই বারে বারে চিঠিতে আঁকিয়া রক্তকালির রেখা
কাগজের সাথে ভাল করে বাঁধি- তোমার সে-সব লেখা।
তুমি ভাবিও না, সাক্ষ্য মানিয়া চিঠির কয়টি পাতা
সারারাত আমি ভুল বকিতেছি আপনার মনে যা-তা,
-আমি তাহাদের লুকাইতে চাই যেন কভু কোনোমতে
সেই বিস্মৃত দেশ হ’তে তারা পারে না বাহির হ’তে।
ভাবিও না তুমি সময়ের মোর হইয়াছে বাড়াবাড়ি,
প্রমাণ করিব চিঠিতে যা তুমি মিথ্যা করেছ জারি।
অবসর নেই। তুমি ভুলে গেছ আমিও ভুলিতে পারি;
-আমার দিবস রজনী কাটিছে ভুল গেঁথে সারি সারি।
তুমি ভুলে গেছ, হয়ত তেমনি কাটিছে তোমার বেলা
আলসে এলায়ে কবরী হেলায়ে পাতিছ রূপের খেলা।
হয়ত অধরে আজিও আঁকিছ তেমনি সুঠাম হাসি
সোনা তনু বেয়ে পথে পথে তারি ছড়াইছে রাশি রাশি,
হয়ত সে মুখ আজো উচ্চারে, ভালবাসাবাসি কথা,
হয়ত তাহাই জড়ায়ে হাসিছে কত পরিণয়-লতা!
এ সব তোমারে শুধাব না আমি, অবসর নাহি মোর-
ভুলিয়া ভুলিয়া করিব যে আমি জীবন-আয়ুর ভোর!
তোমারে ভুলিব- যে আলো জ্বলিয়া স্মৃতিরে বাঁচায়ে রাখে
আজিকে তাহারে রাখিয়া যাইব জীবনের পথবাঁকে-
সুমুখে এখন নাচিবে আমার মরণের আঁধিয়ার,
আমি তার মাঝে বসিয়া গাঁথিব কেবলি ভুলের হার!