বিজয়চণ্ডী

পুরোহিত, তব শান্তি-মন্ত্র
ক্ষণকাল তরে তুলিয়া রাখ’-
আজি একবার রুদ্র কণ্ঠে
বিজয়চণ্ডী মায়েরে ডাক’।
বহুদিন হ’ল, শুনিনি সে নাম,
কতদিন সে যে নাহিক মনে,
বিস্মৃতপ্রায় লুপ্ত-চেতনা
সুপ্ত ছিলাম শয়ন-কোণে;
শাস্তি শান্তি শুনিয়া কেবলি
ভ্রান্তির মাঝে অন্ধ দিশা,
কোথায় শান্তি, কিসের শান্তি-
চির অতৃপ্ত প্রাণের তৃষা;
অন্নবিহীন বস্ত্রবিহীন
দৈন্যনিলীন দেশের চোখে
মিথ্যার ধূলি ছড়ায়োনা আর
আজি প্রভাতের পুণ্যালোকে।
অমিয়-রচন স্বস্তি-বচন
আচাৰ্য, আজি ভুলিয়া থাক’-
দপ্তকণ্ঠে, শুনি একবার-
বিজয়-চণ্ডী মায়েরে ডাক’।
নর্স্মদা-রেবা-সিন্ধু-কাবেরী,
ব্ৰহ্মপুত্র-গঙ্গাতীর-
দেশ-দেশান্ত-মিলিত আজিকে
মন্দিরে তব অযুত বীর;
এসেছে কি তারা তোমার হাতের
শান্তিজলের লভিতে ছিটা,
স্বস্তির ঝুটামন্ত্র শুনিতে
এসেছে ছাড়িয়া বাস্তুভিটা!
বক্ষে তাদের ঝঞ্ঝা বহিছে,
চক্ষে অনল বজ্র-আঁকা,
মিখ্যা মন্ত্র শুনায়োনা আর
শূন্যগর্ভ বচন ফাঁকা;
উদ্ধত কত ক্ষুব্ধ বাসনা
উদ্যত শত লুব্ধ আশা,
সিদ্ধির শুধু ইঙ্গিত তরে
ঐ মুখে তারা খুঁজিছে ভাষা;
থাকে যদি তব অভয়মন্ত্র
থাকে যদি তব অগ্নিবাণী,
লক্ষ পরাণ বিদ্ধ করিয়া
প্রাণ হ’তে প্রাণে দাও তা হানি’।
দেবী দশভুজা লইবেন পূজা,
আচার্য্য, আজি করোনা ভুল,
ভুলা’তে চেয়োনা দেবতারে শুধু
সঁপি’ গোটাকত গাছের ফুল;
তুষ্টি হবে কি জগন্মাতার
ডাল-ছেড়া দুটো বিল্বদলে,
নিঃস্বদীনের কৃত্রিম সেবা-
অশ্রু-লবণ গঙ্গাজলে!
জানেন জননী মর্ত্ত্য জীবের
জঠর ভরে না যজ্ঞধুমে,
আত্মার লাগি’ অন্ন যে চাহি,
সে অন্ন নাহি ছড়ায়ে ভূমে;
চাই আলো বায়ু চাই পরমায়ু
চাই যে স্বাধীন সবল চিত,
সে প্রাণের পূজা লন না জননী,
যে প্রাণ সতত শঙ্কাভীত!
দুর্ব্বল দেহে দুর্ব্বল প্রাণ-
আনন্দহীন ভীরুর দলে
মৃন্ময়ী কভু চিন্ময়ী হয়-
কোন্ কল্পনা শক্তি বলে?
বিরাট বিশ্বমাতারে বরিয়া
কেমনে সে মূঢ় বাঁধিবে কাছে,
বক্ষের নীচে শূন্য জঠর
হাঁ করিয়া যার পড়িয়া আছে!

চির সুধাময় এই সে শরৎ-
এই ত দিগ্বিজয়ের দিন,
মহেশ্বরের মহাকাশতলে
মহাশ্বেতারা বাজায় বীণ;
শুভ্র সূৰ্যকিরণের তারে
সুরের চামর পড়িছে ঝরি’,
বরষা-অস্তে মেঘান্ধকার
আশার আলোকে উঠিছে ভরি’;
হাঁসের পাখায় ঐ শোনা যায়
সুরের লহরী গগন ছেয়ে;
চল্-চল্-চল্ চল-চঞ্চল
তটিনী চলেছে ধরণী বেয়ে;
দিগ্বিজয়ের এই ত সময়-
কৰ্ম্মযোগের লগ্ন এই,
বিজয়ার পায়ে বিজয়-বিদায়ে
আজ আর কোন বিঘ্ন নেই;
পুরোহিত, মিছা শান্তিমন্ত্রে
কূলে আর কারে রাখিবে ধরে’?
পশ্চিমে হাওয়া লেগেছে তরীতে
ফুলে’ উঠে পাল পলকে ভরে’।

বিজয় চণ্ডী নামের প্রসাদে
দিকে দিগন্তে যাক্ সে ছুটে’,
দেশ-দেশান্ত খুঁজিয়া আনুক
নব নব ধন ধরণী লুটে’;
লঙ্ঘি’ ভূধর, মন্থি’ সাগর,
পার হয়ে মরু, খুঁড়িয়া খনি,
দুঃখ সহিয়া আনুক্ বহিয়া
মায়ের পায়ের যোগ্য মণি;
আৰ্য্যের পূজা করিবে সে আজি
আৰ্যেরি মত বজ্র বলে,
অশ্বমেধের বিজয়ী অশ্ব
ছুটুক আজিকে বিশ্বতলে।

ছুটুক সে আজি বিজয়মত্ত
টুটুক মিথ্যা মোহের জাল,
লুটুক আকাশে শিব-তাণ্ডবে
কটিতটে-বেড়া বাঘের ছাল;
উঠুক ফুলিয়া প্রলয়োচ্ছল
মহানীল জটা জগৎ ঘিরে’,
পড়ুক টুটিয়া কঙ্কালমালা
নীলকণ্ঠের কন্ঠী ছিঁড়ে;
শৈলে শৈলে উঠুক গর্জ্জি’
বন্ধনহারা ভুজগদল,
রুদ্র-ত্রিশূল-ঝন্ঝনানিতে
মন্থি’ উঠুক সাগরতল;
ডিণ্ডিমিডিমি ডমরুর ডাকে
ব্রহ্মাণ্ডেতে পড়ুক সাড়া,
চরণের চাপে ক্ষুব্ধ বাসুকি
উঠুক সে দিয়া অঙ্গনাড়া!

নব যুগান্তে নবীন শান্তি
আসিবে নিখিল ভুবন যুড়ে’,
পুরোহিত, তব শান্তিমন্ত্র
সেইদিন গেয়ো নূতন সুরে;
তার আগে সেই মামুলি মন্ত্র;
ঋত্বিক, তব মিথ্যা কথা-
সে যে অপমান মরণ-অধিক
ব্যথার উপরে দ্বিগুণ ব্যথা!