দেবেন্দ্রনাথ সেন

কে বলিল? মিছা কথা! কবি নাই- কে বলিল, নাই!
ওকথা বলিতে আছে? ষাট ষাট, বালাই বালাই।
বাছা যে অমর মোর- জানিস্ না তোরা এতদিন?
অথচ করিস্ বাস তারি সাথে, ওরে লজ্জাহীন,
এক সঙ্গে এক ঘরে, আমারি কোলের কাছে বসি’,
সেই মুখে শিখি’ ভাষা; পোড়া ভাগ্য- কারেই বা দোষি
ভাই চেনেনাক ভায়ে, যে ভাই ভায়ের মত ভাই,
যে ভাই মরণজয়ী- তারে আজ বলে কিনা, নাই!
ভাষা আছে, কবি নাই- এ কথা কি সত্য হ’তে পারে?
বালাই বালাই, ষাট্- মরণের সে কি ধার ধারে!

এই ত আছিস্ তোরা, এই ত বলিস্ তার কথা,
মুখে-মুখে তারি নাম, বুকে-বুকে জাগে তার ব্যথা;
গৃহস্থের ঘরে-ঘরে কোণে-কোণে ভাঁড়ারে-ভাঁড়ারে,
নারী মঙ্গলের মাঝে সদাই দেখিতে পাই তারে;
আটপৌরে রাঙাপেড়ে সাড়ীখানি, সে যে তারি দান,
‘ইন্দুমুখে গালভরা হাসিটুকু তারি ত সন্ধান!
‘গৃহ-শকুন্তলা’ গুলি বেড়ে উঠে গৃহ-তপোবনে-
একরাশ কালোচুল এলো করি’ বঙ্গেরই অঙ্গনে!
বাড়ীভরা ছেলে-মেয়ে- ‘শিশু নাগাসন্ন্যাসী’র দল
করতালি দিয়ে নাচে, কে নাচায় কল্পনা-কুশল!
‘বিধবার আসি’ হেরি’ কার চক্ষে অশ্রু নাহি ফুটে,
‘শালীর পায়ের মল’-এ বক্ষ কার নেচে নাহি উঠে?
‘সর্ব্বতীর্থসার’ মার মধু ডাকে মন যদি ভরে,
‘হরিমঙ্গলের’ গানে প্রাণে যদি শান্তিসুধা ঝরে,
‘অশোকের গুচ্ছ’ যদি স্পর্শে তার হয় আরো লাল,
তারি তলে খেলা করে ঘরে-ঘরে আনন্দদুলাল;
প্রিয়া যদি তারি মন্ত্রে হয়ে উঠে প্রাণ-প্রিয়তমা,
‘বিপদের শাঁক মূর্তি’ তারি করে চিত্তমনোরা,’-
তবেই ত মরেনি সে, তোদেরি দৈনিক সুখে-দুখে,
ঘরে-ঘরে বেঁচে আছে- আহা! তাই বেঁচে থাক্ সুখে।

কাব্যের ‘সোনার তরী’ লেগেছিল যার বক্ষকূলে
একদিন বাঙ্গলায়- সে দিন কি গিয়েছি ভুলে’?
সে তরী ভিড়ে কি কভু ধরণীর যে কোন বন্দরে!
সে যে অ-মরার দেশ- জানিস্না তোরা কি অন্ধ রে!
প্রেমের সে নবদ্বীপ ভাবের সে নব বৃন্দাবন,
ভক্তির সে বারানসী কল্পনার নবীন নন্দন-
সে হাট কি ভাঙ্গে কভু, সে নিৰ্কর কভু রসহীন,-
মানব চিত্তের তীর্থ সে যে নিত্য অম্লান নবীন!

আত্মার অনন্ত ধারা যুগে-যুগে সেথা নিস্যন্দিত,
তাহারে করিবি ক্ষুণ্ন, তোরা কি রে এতই পতিত?
বঙ্গের কবীর কবি, ভক্তিরসে সিদ্ধ সুরসিক,
বিলাসবিমুক্ত পথে মৌন যাত্রী নিষ্কম্প নির্ভীক,
ত্যাগের জ্বলন্ত মূর্তি- নিষ্ঠার কাঠি দিয়ে গড়া,
অথচ শিশুর মত সরল হাসিতে মুখ-ভরা;
শ্রীকৃষ্ণের পাঠশালে প্রেমে-পড়া পড়ুয়া প্রবীন
ভক্তি-মান-এ চিরাধ্যায়ী অনুত্তীর্ণ যেন চিরদিন;
মুক্তিকামী মহাপ্রাণ- সে প্রাণে করিবি অস্বীকার-
আত্মার বর্তিকা সে যে- চিরদীপ্ত চির নির্বিকার!
যা বলার, বলেছিস, বলিসনে আর, কবি নাই-
সে কি মোর যে-সে পুত্র! যা যা, বালাই বালাই!