কলঙ্কিনী

বৈশাখের অপরাহ্ন; তপ্ত রবি অগ্নি-আঁখি হানে;
পদপ্রান্তে পড়ে’ আছে অনিমেষে চেয়ে তারি পানে
মুহ্যমান মৌন ধরা; শূন্যদৃষ্টি সরোবরতীরে
নারিকেলতরুকুঞ্জ মর্ম্মরিয়া কাঁপিতেছে ধীরে
দুলায়ে চামর-পত্র; তীরাস্তৃত বেতসের বন
বিম্বিত ছায়াটি তারি বিস্মিত করিছে নিরীক্ষণ।

তীরের কুটীর ছাড়ি’ গ্রীষ্মতাপে সেবা জম্বুমূলে
বসিয়াছিলাম একা আঁখি রাখি’ সরোবরকূলে!
সহসা হেরিনু’ দূরে অপ্রশস্ত বনপথ দিয়া
ত্বরিত চরন ফেলি’ দীঘিজলে নামিল আসিয়া
অবীরা চণ্ডালকন্যা পল্লীকলঙ্কিনী সেই ‘তারা’!
টুটিল অলস স্বপ্ন; মূর্ত্তিমতী বিদ্রোহের পারা
ভাঙিল সহজ শাস্তি; সুনির্ম্মল সরোবরবারি
শিহরি’ উঠিল যেন অসংযত অঙ্গস্পর্শে তারি!

তবু রহিলাম চাহি’- অদৃশ্য তাহার নেত্রপথে-
সঙ্কোচের আবরণ সাধ্বসে সরায়ে কোনমতে!
চঞ্চলা ও রঙ্গময়ী তরঙ্গেরই নর্ম্ম-সঙ্গিনী সে-
রসে-ভরা অঙ্গখানি সরসীর সঙ্গে গেছে মিশে’;
আয়ত উরস ‘পরে উৰ্ম্মিগুলি হেসে করে খেলা;
কুঞ্চিত চিকুরদাম- তরঙ্গিত শৈবালের মেলা
ভাসে মুখপদ্ম বেড়ি’; আন্দোলিত বাহু-মৃণালের
ললিত লাবণ্য ভঙ্গী- ইঙ্গিত যেন সে আনন্দের!
লীলায়িত তনুখানি সঞ্চারিয়া উদ্দাম কৌতুকে,
সৃজি’ নব ইন্দ্রধনু মুখজলে, মুক্তামালা বুকে-
দাড়াইল স্নানশেষে তীরপ্রান্তে, বিচিত্র বসনে
উচ্ছলিত যৌবনের বন্ধুরতা কসিয়া শাসনে।
সহসা ফিরায়ে মুখ, আর্ত্তকণ্ঠে- ‘ওমা ওকি’ বলি’
চকিতে নামিয়া নীরে দ্রুত সন্তরণে গেল চলি’
ওপারের তীর লক্ষ্যি’। সবিস্ময়ে চাহি’ সেই পানে
হেরিনু গোবৎস এক উৰ্দ্ধমুখে সন্ত্রস্ত নয়নে,
মুক্তি-আশে পঙ্কমাঝে করিতেছে প্রাণান্ত প্রয়াস;
শৈবালে আচ্ছন্ন দেহ, চরণে জড়ায়ে গেছে ফাঁস!
উদ্ভ্রান্তের মত বালা ক্ষিপ্র পদে পঁহুছি’ সেথায়
ত্বরিতে বিপুল বলে বাহুপাশে তুলিয়া তাহায়,
বহুযত্নে শিশুসম অংশোপরি রাখি’ মুখখানি,
সাবধানে জল হ’তে তীরে তারে কোনরূপে টানি’
আনিলা অনেক কষ্টে; রাখি’ ধীরে তীরলগ্ন ঘাসে,
বাহুপাশে বাঁধি’ তার গ্রীবাখানি বসি’ তার পাশে,
করটি বুলায়ে ধীরে চোখে-মুখে স্নেহ-সুকোমল,
একান্ত আগ্রহভরে, বারেক তাহার গণ্ডস্থল
চুম্বিলা নিবিড় স্নেহে- মাতা যেন কাতর সন্তানে
পরিপূর্ণ মমতায় শেষে তারে রাখি’ সেইখানে,
সরোবর অতিক্রমি’ পুনরায় সন্তরণ দিয়া,
এপারে যখন ধীরে উপজিল, দেখিনু চাহিয়া-
পরিপাণ্ডু মুখচ্ছবি, বক্ষ কাঁপে, নয়ন অলস,
শ্রান্ত দেহ অবনত; বাহুমূল শিথিল অবশ-
ফিরিলা গৃহের পথে মন্থর চরণ দুটি ফেলি’,
স্নেহস্নিগ্ধ সুধারসে সুস্মিত নয়ন দুটি মেলি’!

সহসা বিটপী-শাখে, উর্দ্ধে মোর, পল্লবেতে ঢাকা-
অজানা বিহঙ্গ এক অন্ধকারে ঝাপটিল পাখা!
* * * * * *
একদণ্ড পূর্ব্বে যারে ভাবিয়াছি কলঙ্কের ডালি,
পঙ্কিল পরশ ভাবি’ মনে-মনে পাড়িয়াছি গালি,-
সেই নারী-কলঙ্কিনী নিমেষে অপূর্ব্ব মূর্ত্তি ধরি’
দৃষ্টির সম্মুখে মোর সৃষ্টিরে সুন্দরতর করি’
উদ্ভাসি’ উঠিল চক্ষে রমণীর বিপুল গৌরবে!
পূর্ণশশী উঠে যবে- কলঙ্ক কে দেখে তার কবে?