মালোর মেয়ে

মস্ত একটা বড় বটগাছ ভৈরব নদীর ধারে-
ছাতরা-বট তার নাম;
ছাতার মতন পাতায়-ছাওয়া, তলায় সারে-সারে
হাজার ঝুরির থাম।
জষ্টি মাসের দুপুর বেলা, খাঁ খাঁ করছে দিক,
চক্ষে যায়না চাওয়া,
গাছের তল়্টায় কতক ঠাণ্ডা, ঘরের মতন ঠিক-
হু হু করছে হাওয়া।
নদীর পাড়ে পথের ধারে রথের মতন লোক-
বালক, যুবা, মেয়ে,
সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক্রে’ যাচ্ছে চোখ
গাছের পানে চেয়ে।
ঐ দ্যাখ্, কাঁদছে- শুন্তে পেলি? ঐ দ্যাখ্রে আবার-
বলছে এ ওর ঠাঁই,
হাঁ রে, এইবার ঠিক শুনেছি- আজ ত মঙ্গলবার-
সারলে বুঝি ভাই।
রাত থেকে কাল কচি-ছেলের কান্না আস্ছে কানে,
গাছের মধ্যে থেকে;
চিরকালের ‘হানা’ গাছ- তা সব্বাই লোকে জানে-
আজ তা চোখে দেখে।
বল্লে বলাই- দেখব আমি? করলে সব্বাই মানা,
-যানে খবরদার!
জোলার ছেলে যোয়ান ভারি, চ্যাটাল’ বুক খানা,
পাড়ার সে সর্দার।
কষ্টি-কালো কোঁকড়া-কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের রাশ
ঝাঁকিয়ে মাথার ‘পরে,
জল্দি পায়ে এগিয়ে সেদিক চল্ল বলাই দাস,
চোখ তার চক্চক্ করে।
মর্ল চাষা, বলল একজন ভিড়ের মধ্যে হ’তে-
টেরটা পাবেন ছেলে!
ফির্ল বলাই যেম্নি শুন্ল, এগিয়ে চল্তে পথে
লাঠিগাছ তার ফেলে’।
অবাক হয়ে হাস্ছে, দেখল, যত দলের লোক,
সেদিক পানে চেয়ে;-
একটা ধারে ছল্-ছল্ করছে কেবল দুটি চোখ-
মালোদের সে মেয়ে।
মুখখানা তার ভারি ভার-ভার, মস্ত যেন ভয়
মনের মধ্যে পোষে-
সেই মেয়েটা, লোকে যারে দুষ্ট দজ্জাল কয়-
বজ্জাৎ বলে’ দোষে।
চল্ল বলাই- হাঁচড়-পাঁচড় কেটে কোনমতে
উঠ্ল সে আগ্ডালে,
তাকিয়ে রইল গাঁয়ের লোক সব- দাঁড়িয়ে তেম্নি পথে,
হাত দিয়ে সব গালে।
উড়ে’ গেল এক ঝাঁক পাখী পেয়ে পায়ের সাড়া,
ফড়্-ফড়্ করে’ পাখা,
মড়াস করে’ শব্দ হল- ঐরে ফল্ল ফাঁড়া!
উঠ্ল নড়ে’ শাখা!
ছেলের কান্না যেম্নি থাম্ল- ভয়ে সব নিশ্চপ-
কেঁপে উঠ্ল বুক,
রামনাম করতে লাগ্ল কেউ-কেউ, সবার প্রাণ তুপ্তুপ্,
শুকিয়ে উঠ্ল মুখ!
খানিক পরে দেখ্ল কিন্তু বলাই আস্ছে ফিরে’,
কি একটা তার হাতে,
কিরে, কিরে? করে’ অমনি ধর্ল তারে ঘিরে,
সকলে এক সাথে।
কিচ্ছুনা ভাই- এই ছানাটা চেঁচাচ্ছিল বাসায়,
বল্লে বলাই চেয়ে-
একটা ধারে চোখ্ দুটো কার ছল্কে উঠ্ল আশায়-
মালোদের সে মেয়ে।
সেদিন রাতে শোবার আগে হাতের কাজ সব সেরে,
ভাব্ল জোলার ছেলে,
মালোর মেয়ে ভারি ত আজ মন্টা গেল মেরে,
চোখের জলটা ফেলে!
একই পাড়ায় পাশাপাশি বটে তাদের বাড়ি,
ছেলেবেলার সই, কিন্তু সেই ত বিয়ের পরে জন্ম-ছাড়াছাড়ি,
দেখাই তার আর কই!
শশুরবাড়ী থেকে কদিন এসেছে- তাই জানি,
দেখা নদীর ঘাটে,
আমায় দেখে’ পালিয়ে গেল- ডুরে কাপড়খানি
উড়িয়ে দিয়ে ঠাটে!
কোন’ কথাই কইলেনাক, তাই ভাব্লাম মনে,
ভুলেই বা সে গেছে-
ছেলেবেলার ভাব ত সারা ছেলেখেলার সনে-
কে আর যাবে যেচে!
আজকে হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে- দুশো লোকের মাঝে,
কেমনটা ব্যাপার?
আমার জন্যে ভয়টা যেন তারই বুকে বাজে-
দরদ এত তার!
তিনটে বচ্ছর গেছে কেটে- এই ঘটনার পর,
ছাতরাগাছী গ্রামে;
শেষ বছরটা এসেছিল যমের সহোদর-
ইনফ্লুয়েঞ্জা নামে,
মানুষ যারা ছিল গাঁয়ে, আদ্ধেক গেছে মারা-
তারি ভীষণ ডাকে;
নদীর পাড়ে গাছটা কেবল তেম্নি আছে খাড়া,
নাওয়া-ঘাটের বাঁকে।
ঝুরিগুলো তেমনি করে’ হাজার খানের সারে
ধরে পাতার ছাদ-
তেম্নি সবই, নাইক কেবল আজকে তাহার ঘাড়ে
‘হানার’ অপবাদ।
জোলাবাড়ি ফেরার প্রায়ই, বলাই আছে নিজে
সব্বাই গেছে মরে’;
শরীরটা তার নেহাৎ মজবুৎ, তাইতে ভাঙেনি যে
অমন রোগে পড়ে’।
মনটাও তার দেহের মতন ভাঙন-ধরা আজ,
ভাব্না আছে ছেয়ে,
তাঁতগুলো সব জালে ভরা- মাকড়সাদের কাজ!
কে দেখ্বে আর চেয়ে!
সে দিনটা সে নদীর ধারে এক্লা বসে আছে,
সন্ধ্যা হয়ে আসে;
দূরে একটা গরুর গাড়ী ঢাকা পড়্ল গাছে
পথের মোড়ের পাশে।
একটা যেন চাপা কান্না তারই মধ্যে থেকে
এল তাহার কানে,
মনটা আরো বিগ্ড়ে গেল, ভাব্ল আবার একে?
চলেছে কোন্ খানে!
সম্মুখে তার ছাতরা গাছটায় দেশের অন্ধকার
নিল তাদের বাসা-
নদীর তীরে ডাক্ল শেয়াল, নিঝুম চারিধার
আঁধার দিয়ে ঠাসা।
দুরে একটা শুয়োর-তাড়ার শব্দ এল মাঠে-
অড়র ক্ষেতের ধারে;
কি একটা সে ছপাৎ করে’ নাম্ল এসে ঘাটে
সম্মুখের ঐ পারে!
মাথার উপর বাদুড় একপাল ঝট্পট্ করে’ পাখা,
চেঁচিয়ে গেল উড়ে’;
উঠ্ল বলাই আস্তে-আস্তে, ভারি একটা ফাঁকা
বুকটা ফেল্লে যুড়ে’।
পহর খানেক রাত্তির তখন, বলাই জোলার ঘরে
নাইক জনপ্রাণী;
কেরোসিনের ডিপে একটা ছাড়্ছে দাওয়ার ‘পরে
ধোঁয়া অনেকখানি।
মাচার উপর চুপটি করে’ বলাই বসে’ আছে-
মুখটি নীচু করে’-
নানান রকম ভাবনা ঠেলে উঠছে বুকের কাছে-
চোখ্ তার জলে ভরে’;
এমন সময় বাহির দোরের আগলখানা নড়ে’
উঠ্ল কয়েকবার-
কে রে- কে রে? বলে’ বলাই ঘাড়টা উচু করে’
মেল্ল আখি তার।
বাইরে কিছু যায় না দেখা, এমনি চতুদ্দিক
ঘেরা অন্ধকারে-
একটা শুধু মূর্ত্তি কেবল এগিয়ে এসে ঠিক
দাড়াল তার দ্বারে।
আরে- কেরে? পদ্ম নাকি? বলাই সে দিক চেয়ে
থমকে গেল থামি’-
ভাঙা গলায় কোনমতে বল্লে মালোর মেয়ে-
বলাই দাদা- আমি!