অপরূপ প্রেম

নীলের বুকে সাদার বলক- চোরাবালির চর,
তারি শেষে বাঁকের মুখে একটু ছোট ঘর;
কোলের কাছে জলটি নাচে,
চোখটি সদাই চমকে আছে-
কখন পাছে হারায় বা তার সেইটুকু নির্ভর!

বলে’ গেছে, এই পথে সে আস্বে পুনরায়-
ঠাঁইটুকু তাই ছাড়তে নারি পরাণ ধরে’, হায়!
চৈত্র-রবি অগ্নি হানে,
ভাদ্র এসে ভাসায় বানে-
সবাই আমার মুখের পানে অবাক মেনে’ চায়।

সেই থেকে তাই পড়ে’ আছি, হ’ল কতদিন,
বারোমাসের বোক বয়ে গেছে বছর তিন;
কুঁড়ের চালে নাইক পাতা,
কোনমতে লুকাই মাথা-
কোন্ বিধাতা কবে যে মোর চুকিয়ে লবে ঋণ!

নদীর ‘পরে নয়ন মেলে’ চুপ্টি বসে’ থাকি-
নৌকা আমার কখন্ এসে ফিয়ে’- বা যায় নাকি!
টিটিপাখীর টিটকারীতে
চমকে ফিরি আচম্বিতে,
গাংচিলেরা অম্নি আবার লাগায় ডাকাডাকি!

বাব্লা বনের ঝাপ্সা কোণে ‘চিকেস্’ ডুবে’ যায়,
ঝিঝিরা সব সার বাজায় সাঁঝের আঙিনায়;
হাৎড়ে বেড়ায় পাগল হাওয়া-
কি যেন তার হয় না পাওয়া,
সিরসিরিয়ে শিউরে’ বালি তটের কিনারায়।

সারা নিশি শুনি, পাশেই চখার যায় ডেকে,
সকাল বেলায় দেখি, পায়ের চিহ্ন গেছে রেখে;
চারিধারে যেথাই তাকাই,
ধরে রাখার কিছুই না পাই-
একটি দুটি ঝরা পাখাই যত্নে দি তাই রেখে।

মাঝে মাঝে বাখান-পাড়ার একটা শুধু বাঁশী,
গভীর রাতে প্রাণের পাতে পরশ করে আলি’;
হয়ত কে কার কাজের শেষে,
কাহার লাগি কি উদ্দেশে-
পাঠায় তাহার গোপন কথা বাঁশীতে উচ্ছাসি’।

তন্দ্রাঘোরে যে দিন দূরে শুনি দাঁড়ের টান,
ধড়ফড়িয়ে উঠে ভাবি, হায়রে ভগবান!
ছুটে’ গিয়ে জালের ধারে
চোখটি বিধে’ অন্ধকারে-
চেয়ে দেখি উজান চলে জেলের তরিখান!

আঁধার নিশি কাজল যে দিন পরায় নদীর চোখে,
সজল ব্যথা লুকিয়ে বুকে গুমরে চলে ও কে!
জ্যোৎস্না এসে হাঁসের পাখায়
লুকিয়ে যখন অত্র মাখায়-
ভাবি, আমায় কে দেখে’ যায় চপল চন্দ্রালোকে!

এমনি করে’ দিন কাটে মোর বিজন নদীচরে,
শুন্যে-ভরা আকাশ-ধরার অথৈ অবসরে!
আস্তে যেতে নদীর পথে
কেউ বা চাহে সুদূর হ’তে,
কেউ চাহেনা বাঁধতে তরী চোরাবালির ডরে।

সেদিন রাতে কোথায় হ’তে উঠল হেঁকে ঝড়,
ঢেউএর ঘায়ে জাগল কেঁপে চোরাবালির চর,
জলের গায়ে সাপ খেলিয়ে,
চম্কে- চাওয়া চোখ মেলিয়ে-
মেঘের জটা উড়িয়ে দিল প্রলয়-বাজীকর।

তারি মাঝে হঠাৎ যেন স্বরটি এল কানে,
মনটি যারে মনের মধ্যে ভাল করেই জানে;
অজানা কোন সুখের ঘায়ে
চনচনিয়ে উঠল গায়ে-
মনে হ’ল- শেষ হ’ল সব সহসা সেইখানে।

বলেছিল, আসবে ফিরে’, মিথ্যা সে কি হয়?
প্রেমের বাণী মিথ্যা হবে, প্রাণের পরাজয়!
অবশ বাহু কষ্টে তুলে’-
আচম্বিতে আগল খুলে’
চমকে দেখি- হায়রে একি! এত সে জন নয়!

এ যেন কোন অচিন অতিথ- মৃত্যুলোকের চর,
রক্তে-ভরা শুভ্র তাহার সর্ব কলেবর;
ওষ্ঠে ফুটে দারুণ ব্যথা,
চক্ষে করুণ বিহবলতা;
কোন্ সমাধির তন্ময়তা আননে ভাস্বর!

তবু যেন তার সাথে কোন্খানে মিল আছে,
পুরানো সেই আদল আসে নূতন রূপের পাছে;
মাধুৰ্য্য ও ভীষণতায়
দুটি চোখে দুই জনে চায়-
ভালবেসে ভয় করে তাই এগিয়ে যেতে কাছে।

তুষার-শীতল হাতটি আমার পরশ করে’ হাতে,
ঝড়ের গলায় কইল হেঁকে- পারবে যেতে সাথে?
কোনমতে শুধানু তায়-
কোথায় ওগো, ওগো কোথায়?
সঙ্কেতে সে চাইল কেবল নদীর সীমানাতে।

ঝিলিক-হানা বাজের আওয়াজ কড়কড়িয়ে বাজে;
জলের বুকে ঝড়ের ঝাপট প্রলয় বেশে সাজে!
তারি অসীম অতল তলে
সে কি আমায় ডুবতে বলে?
সেইখানে কি মিলবে মণি অন্ধকারের মাঝে!

তার পরে আর কি যে হ’ল, মনে সে আর নাই-
জেগে দেখি- আছি পড়ে’ চরের কিনারায়;
পূর্ব কথা স্বপ্নসম
জাগছে শুধু বক্ষে মম
জীবন মরণ এক হয়ে মোর মুখের পানে চায়!

গাংচিলের তেম্নি পাশে করছে ডাকাডাকি,
রৌদ্রালোকে বালির চরে তেম্নি মাখামাখি;
নদীর বারি কৌতূহলে
তেমনি করে গুমরে চলে,
নাই শুধু সেই পরশমণি, মরণ শুধু বাকী!