পঞ্চাশোর্ধ্বে

পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যাবে- চলেছি তাই বনে!
মনটা তবু থেকে-থেকে দুলছে ক্ষণে-ক্ষণে-
কত দিনের ঘরের সাথে কতই পরিচয়,
কত দিকে কত বাধন, কত-না সঞ্চয়;
হাজার পাকে শিকড়-বেড়া চিত্ত-লতার জালে
কেমন করে উপড়ে আবার বাঁধব গাছের ডালে!
বাক্যহারা ঘর-বধু যে বাতায়নের ফাঁকে
অশ্রুজলের আবছায়াতে দৃষ্টি মেলে থাকে!

ভাবছি মিছে- যেতেই হবে, এলই যখন ডাক,
মনের কানে ঢেউ তুলেছে সন্ধ্যালোকের শাঁখ;
দিনের দাহ জুড়িয়ে আসে দেহের সীমানায়,
অন্তু রবির রঙটি লেগে বনটি কী মানায়!
সিন্ধু জলের গন্ধ-আমেজ লাগছে এসে নাকে-
এই অবেলায় ঘরের খেলায় বন্দী কি কেউ থাকে?
সন্ধ্যাতারায় দৃষ্টি হারায়, সামনে পিছে কালো,
পারের পথের যাত্রী যখন, এগিয়ে থাকাই ভালো!
আজ মনে হয়, বনের মানে মুক্তিই স্বাদ চাখা,
বাঁধন যবে ছিড়তে হবেই, ভার কেন আর রাখা?
দেহের শিকল কাটার আগে, আলগা করি মন
মৃত পথে রাখাই ভালো মুক্তি-নিমন্ত্রণ।
বৈতরণীর মন্দিরে যে পারের ঘন্টা বাজে,
তকমা তাবিজ তল্পি কি আর লাগবে কোনো কাজে?
দেহের ক্ষুধার জোগান দিয়ে, ছুটির আগে আজ
মনের ক্ষুধার তৃপ্তি লাগি নাই কি কোনো কাজ?

যতই বলুন কবিরা সব- ‘কোকিল ডাকের মানে,
পঞ্চাশতের নিচে যারা, তারাই ভালো জানে!’-
চঞ্চলতার মাঝ-দরিয়ায় স্রোতের মুখে ভেসে
কবে কে আর দেখলে চেয়ে তটের সীমা-দেশে!
স্রোত কাটিয়ে বসতে পেলে শান্ত হয়ে তটে;
কুঞ্জ-শোভা তখন পড়ে সহজ আঁখিপটে।
আপন-হারা আকুল বনে কোকিল ডাকে মিছে-
কুহুধ্বনি মারা পড়ে রক্তধ্বনির পিছে!
অন্ধ বকুল গন্ধ-পখে দেয় যে লিপিখানি,
প্রিয়ার খোঁপায় কে বুঝবে হায়! তার বেদনার বাণী?
মধু ঋতুর উৎসবে যে বাঁধতে চাহে ঘরে,
তার চোখে কি পুষ্পশোভার উৎস ধরা পড়ে?
লতার বেণী বাঁধন হয়ে বাঁধে যে তার মন,
মিথ্যা পাঠায় সৃষ্টি তারে দৃষ্টি-নিমন্ত্রণ।
নয়ন-পথে গ্রহণ যাহার, চয়ন-পথে নয়,-
যেজন অবোধ, সেই রসবোধ তার কাছে কি হয়!
মিথ্যা ভাবা ঘরের কথা- কোথায় তোমার ঘর?
শাখার ফাঁকে ঐ দেখা যায় বিশ্ব-চিদম্বর!
সীমাহারা ঐ আকাশে মুক্ত হওয়ার মাঝে
প্রাণের কানে শোন্ দেখি কোন না-শোনা সুর বাজে!
সৃতিকা-ঘর রয় না যেমন গৃহবাসের ঘরে,
মাটির-ইটের-কাঠের ঘরের বদল পরে-পরে,
দেহবাসের ঘরও যখন মনোবাসের নয়,-
বনবাসেই যাক না দেখা শেষের পরিচয়।