রবি-প্রশস্তি

রঞ্জিত করি’ পশ্চিম তট দীপ্ত প্রতিভাজালে
সূৰ্য্য আজিকে উদিল পূর্ব্ব উদয়গিরির ভালে;
পুণ্য পরশ লভি’ আজি তারি জাগ্ ওরে তোরা জাগ্-
বিশ্বসবিতা সেই রবি-করে দেরে দে যজ্ঞভাগ!
সহস্রদল বাণীর কমল মুদিত মানস-সরে
দিক্ দিগন্ত মুগ্ধ করিয়া ফুটিল যাহার বরে,
অমৃত গন্ধ আনন্দরূপে দান করি’ যে বা লোকে-
নব জীবনের দীপ্তি আনিল মৃত্যু-আহত চোখে,
তাহারি মুক্ত মিলনাঙ্গনে জাগ্ ওরে তোরা জাগ্-
বিশ্ববিজয়ী সেই রবি-করে দেরে দে যজ্ঞভাগ।

খণ্ডিত নয় এ মহাযজ্ঞ, অনন্ত অফুরণ,-
এই বিশ্বের লোকে লোকে আজ আলোক-নিমন্ত্রণ;
শক্তির মোহ মিথ্যার মায়া সবলে করিয়া দূর
ভুবনধন্যা জীবনবন্যা বহে আজি ভরপূর;
আয়রে পূর্ব্ব আয় পশ্চিম, আয় তোরা সবে আয়-
বিশ্বভারতীমন্দির-তলে মিলন-মধুচ্ছায়।

যা-কিছু যাহার কলঙ্ক কালী, যাহা ‘অচলায়তন,’
সত্য-আলোকে ধুয়ে নে রে লভি’ সে দীপ্ত বরিষণ।
মৰ্ম্মপুটের মণির মুকুর উচ্চে তুলিয়া ধর্-
সবার উর্দ্ধে জ্বলুক সে আজি শাশ্বত ভাস্বর।

জগৎ-সভায় রবি তুমি আজ নহ শুধু আর কবি-
অমৃত-প্রতিভা-ভাণ্ডার-ভরা তুমি আলো-কবা রবি;
তোমারি প্রভায় উজল সপ্ত সাগর, সাগর-পার,
পূর্ব্বোত্তর দক্ষিণদিশি উজ্জ্বল চারিধার;
কুরুক্ষেত্ৰ-কালরাত্রির তমসার অবসানে
তোমারি কিরণ দূর পশ্চিমে নব জাগরণ হানে!
বিশ্বসভার মহা-রাজসূয়ে তুমি পুরুষোত্তম,
কৰ্ম্মের রথী ধৰ্ম্ম-সারথি জ্ঞানে মানে অনুপম;
শিশুপাল ছাড়া তোমারে সকলে বরিষ্ঠ সম্মানে
অর্পিছে, আজি প্রাণের ভক্তি শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য দানে।

লহ ওগো লই আজি এ অর্ঘ্য উর্দ্ধ আকাশ-পথে,
যেথা তব মহা বিজয়-যাত্রা শুভ্র আলোক-রথে;
চন্দ্র যেথায় অতন্দ্র চোখে সাজায় বরণডালা,
কাতারে-কাতারে শোভিছে লক্ষ নক্ষত্রের মালা;
জ্যোৎস্না বিছায় অঞ্চলবাস ছায়া-পথখানি ‘পরে,
মেঘেরা মিলিয়া চরণের তলে শঙ্খধ্বনি করে;
সঙ্গীতে মাতি’ গ্রহেরা ফিরিছে অনুগ্রহের লাগি’,
নাচে ছয় ঋতু মোহন নৃত্যে চিরদিনরাত জাগি’;
জানি না সেথায় পঁহুছিবে কিনা এ ক্ষীণ কণ্ঠস্বর-
জানি- শুধু দীন যাত্রীজনের তুমি চিরনির্ভর।

কেন দীন বলি? আগরি কণ্ঠে স্বাগত জানায় মাতা,
সাতকোটি নিজ সন্তানসাথে উন্নত যার মাথা;
যাহার যশের কীৰ্ত্তি আজিকে ঘোষিছে জগৎময়,
ভিক্ষুক যে-বা শিক্ষক হয়ে ভুবন করিল জয়-
সে যে সেই রাণী বঙ্গবাণীরই বুক-আলোকরা ধন,
বিশ্বভুবন নন্দিত-করা বন্দিত নন্দন।
সেই বাণী আজি আমারি কণ্ঠে পাঠায় তাহার বাণী,
অক্ষম হোক্, তবু তোমা তরে গাঁথা এ মাল্যখানি;-
পর আজি গলে- দেখুক বিশ্বসাহিত্য-পরিষৎ।
বঙ্গবাণীরই কোলে দোলে আজ ভুবন-ভবিষ্যৎ!

* বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কত্তৃক ১৩২৮ সালে রবীন্দ্র-সম্বৰ্ধনা উপলক্ষে পঠিত।