সত্যদাস

পণ্ডিতের পদ লভি’ যেদিন বসিনু বেদ গ্রামে,
সেইদিন প্রাতঃকালে ছাত্র এক সত্যদাস নামে
বিদ্যা অধ্যয়ন তরে মোর কাছে দাঁড়াইল আসি’;
-এতটুকু শিশু একা! চেয়ে দেখি- দূরে আছে দাসী!

সযত্নে বসায়ে পাশে, শিষ্ট বাক্যে ভুলাইয়া তারে,
শুনিনু অনেক কথা সুমিষ্ট আত্মায় ব্যবহারে;
পিতৃহীন, নিরুপায়, দরিদ্র সে- ঐ তার ঘর;
দাসী ভেবেছিনু যারে- মা তাহার, নহেক অপর!

ত্বরিতে আসন ছাড়ি’ সসম্ভ্রমে নোয়াইয়া শির-
মনে-মনে পাদপদ্ম পরশিয়া মৌন জননীর,
কহিয়া আশ্বাসবাণী, বালকের লয়ে শিক্ষাভার,
নিশ্চিন্ত করিয়া তাঁরে ফিরাইনু স্বগৃহে তাঁহার।

পাঁচ বৎসরের শিশু- সরল সুন্দর সুকুমার-
এহেন শৈশবকালে কোন্ প্রাণে জননী তাহার
পাঠাইল পাঠশালে- যদিও তা আঁখির সম্মুখে;
বুঝিনু কিসের আশে- কি গভীর দারিদ্রের দুখে!

মাথায় বুলায়ে হাত, প্রাণে মনে আশীর্বাদ করি’
বিবিধ কথায় গল্পে সকল সঙ্কোচ-শঙ্কা হরি’-
‘বাড়ীতে ক’জন থাক?’- শুধাইনু শিশুরে যখন,
উত্তরিল মৃদুকণ্ঠে- ‘বাড়ীতে আমরা পাঁচজন।’

‘এই না বলিলে আগে- ভাই বোন আর কেহ নাই-
তুমি মার এক ছেলে! আরও ত সে তিনজন চাই!’
তেমনি মধুরকণ্ঠে কহিল সে- “মোরা পাঁচজন-
মা ও আমি, ভোলা আর রাধারাণী আর নারায়ণ।”

‘বাকী তিনজন কে কে?’- শুধাইনু পরম বিস্ময়ে;
গণনায় ভুল ভেবে বালক রহিল চেয়ে ভয়ে!
রাধারাণী কে আবার অন্য কেহ বাড়ীতে ত নাই?’
সে কহিল ‘আছেই ত; রাধারাণী সে মোদের গাই।’

‘ভোলা সে কাহার নাম? হাসিয়া শুধানু তার কাছে;
‘জানেন না? ভারি দুষ্ট সে এক কুকুর-ভোলা আছে;
‘নারায়ণ কে আবার?’- নাম শুনি’ প্রণমি’ চকিতে
কহিল- ‘ঠাকুর তিনি- মা বলেন, বাস তুলসীতে!

প্রণাম করেন নিত্য দিনরাত ডাকেন যে তাঁরে-
পাঁচ জন হ’ল নাক?’- কত আর বলি বারে বারে।’
‘এই পাঁচজন বুঝি?’- হাসিলাম পণ্ডিতের ভানে,
অন্তরে বুঝিনু ঠিক’- সত্যবার্তা শিশুতেই জানে!