আজ

কোথাও রয়েছে মৃত্যু- কোনও এক দূর পারাপারে
পশ্চিম সাগরে এক- যেইখানে সব শেষ তারা
অবসন্ন হ’য়ে যায়- ডুবে যায় ভোরের আঁধারে,
আকাশ পায় না আর যেইখানে সমুদ্রের সাড়া;
আমাদের হৃদয়ের সব আশা-হতাশা যেখানে
বরফের মতো কথা কহিতেছে বরফের কানে-
পরিশ্রান্ত পেগানেরা এক দিন চিনেছিল যারে-
সব-চেয়ে অবসাদ সঙ্গে ক’রে এনেছিল যারা!

সেইখানে আছে মৃত্যু পৃথিবীর আকাশের শেষে
সকল মেঘের ‘পরে- মেঘের রঙের আরও পিছে,
যেইখানে রঙ নাই- রক্ত নাই- সেই এক দেশে
ঘুমন্তের কানে কানে সেইখানে ঘুম কি কহিছে!
ফুরায়েছে শুনিবার জানিবার সব অবসর-
বরফের হাত শুধু বরফের হাতের উপর!
কুয়াশার ঠোঁট শুধু কুয়াশার ঠোঁটে গিয়ে মেশে;
দিনের পায়ের শব্দ মাথার স্বপ্নের মতো মিছে!

রাতের পাখার পাখি ঝরায় না পালক সেখানে,
ধরায় না বাতি আর নক্ষত্রেরা- ক্লান্ত নক্ষত্রেরা-
অবসন্ন নদী ছোটে না ক’ শ্রান্ত সমুদ্রের পানে,
সন্তানের মতো জ’ন্মে পৃথিবীতে জেগে আছে এরা!
ইহারা শিশুর মতো- পৃথিবীর শৈশবের দিন
শেষ হ’য়ে গেছে তবু, বৈকালও যে হয়েছে মলিন।
সকল-শেষের সুর শোনা যায় সকলের গানে-
জীবনের সব সাধ অগাধ মৃত্যুর ঢেউয়ে ঘেরা!

সিন্ধুর শঙ্খের কানে সমুদ্রের সুরের মতন-
রক্তের গানের মতো আমাদের দেহের ভিতরে
হে মৃত্যু, তোমার গান শুনিতেছে- শুনিতেছে মন!
ঘুমন্ত মাথার মতো কোনও এক বিছানার ‘পরে
বুজায়ে রাখিতে চাই যা বুঝেছি, যা জেনেছি- সব!
আকাঙ্ক্ষা চাই না আর, আঘাতের চাই না উৎসব!
অনেক জাগার পর ঘুমাবার করি আয়োজন-
গুহার ছায়ার মতো- ছায়ার গুহার মতো ঘরে!

কারণ, অনেক জেগে আমরা দেখেছি রোদ, রূপ-!
দেবতা দেখে নি ভয়ে- আমরা দেখেছি জেগে জেগে;
দেখেছি সকল আলো হ’য়ে যায় অঙ্গারের স্তূপ
তোমার পায়ের তলে, মানুষের মতন আবেগে
নক্ষত্রেরা কেঁপে ওঠে তোমার জানুর নীচে এসে;
মোমের মতন গ’লে জ্বলেছি তোমারে ভালোবেসে-
আগুন হয়েছ তুমি, হয়ে গেছি আমি তার ধূপ;
বিদ্যুতের মতো তুমি জেগেছ বুকের ‘পরে মেঘে!

দেবতা দেখে নি ভয়ে- সময়ের তাই সে দেবতা!
সকল ঐশ্বর্য- রাজ্য- নিশানের আগে তার জয়!
তোমারে সে দেখে নাই, শোনে নি তোমার মুখে কথা
তোমার ঠোঁটের চুমা তাহার ঠোঁটের তরে নয়!
তোমার চুলের কালো সাপ তার লাগে নি কপালে
পরিচ্ছন্ন আকাশের ‘পরে তার নক্ষত্র সে জ্বালে;
একে একে শেষ হয় সকলের সকল ক্ষমতা-
ফুরায় না কোনও দিন দেবতার সীমানা, সময়!

আর ওই দেবতার ছেলে এক- ক্রুশ তার বুকে;
সে শুধু জেনেছে ব্যথা- ক্রুশে শুধু যেই ব্যথা আছে!
যেই গাঢ় বেদনায় মাথা তার পড়িয়াছে ঝুঁকে,
যে ব্যথার রক্ত তার ক্রুশের উপরে ঝরিয়াছে,
পেগান্ জানিত না তো সেই ব্যথা; তবুও পেগান্
সব-চেয়ে অবসাদে নষ্ট ক’রে গেছে তার প্রাণ!
সব-চেয়ে বড়ো ব্যথা বিষণ্ণতা ছিল তার মুখে,
কারণ ভিনাস্, তুমি এক দিন ছিলে তার কাছে!

এক দিন এক রাত তার কাছে বসিয়াছ এসে,
এক রাত- এক দিন এসেছ আমার কাছে তুমি!
সকল ভুলেছি আমি কেবল তোমারে ভালোবেসে,
ফুলের ঘ্রাণের মতো তোমার মাথার চুল চুমি!
তোমার হাতের ‘পরে এক রাত এই হাত রেখে!
দুই চোখ দিয়ে আমি নিয়েছি তোমার চোখ দেখে!
আজও তুমি জেগে আছ আমাদের অবসন্ন দেশে,
সবাই ঘুমায়ে পড়ে- তবু তুমি পড় নাই ঘুমি।

ভিনাস্ আজও তুমি মাথা তুলে রহিয়াছ জেগে-
ভ’রেছে দু’-ধারে ঘাড় সাপের ফণার মতো চুলে!
ঠোঁটের উপরে ঠোঁট চুমোর মতন আছে লেগে!
ফেনার মতন রক্ত দেহে তার উঠিতেছে দুলে।
গ্রীষ্মের সিন্ধুর মতো তার ওই দেহের উষ্ণতা!
বিমর্ষ ঘুঘুর মতো চোখে তার সে কী বিষণ্ণতা!
হৃদয় ভরিয়া ওঠে অবসাদে- বিষাদে- আবেগে-
বিকালের সমুদ্রের মতো ক্ষুধা উঠিতেছে ফুলে।

তোমার পেগান্ রাজ্য ভেসে গেছে মেঘের মতন-
তাহার সে বজ্র ভেঙে প’ড়ে আছে পৃথিবীর পিছে,
চ’লে গেছে গ্রীক সব- হীদেন্ গ্রীকের মতো মন
তোমার মুখের পানে চেয়ে বুকে আবার জাগিছে!
কোথা আছো?- আজিকার পৃথিবীর কে তুমি দেবতা?
উৎসব তোমার বুকে- আমার এ মুখে বিহ্বলতা?
নক্ষত্রের স্বপ্ন তুমি দেখ, আমি দেখি দুঃস্বপন।
তবুও মিথ্যার মতো দেবতারে মনে হয় মিছে!

কারণ দু’-হাত তুমি রাখ নাই ভিনাসের হাতে;
তোমার দু’-হাত শুধু পেয়েছিল মেরী মাদালিন্-
তাহার চুলের ‘পরে ফুলের মতন আশীর্বাদে,
দেবতার দুই হাত এসেছিল নেমে এক দিন!
আজিকার পৃথিবীর দেবতার এই শুধু সাধ-
শুধু তৃপ্তি- শুধু তৃপ্তি- সান্ত্বনার শীত আশীর্বাদ!
পৃথিবীর ব্যথা ছাড়া আর কোন্ ব্যথা বুকে বাধে?
যে ব্যথার কাছে এই পৃথিবীর সব ব্যথা ক্ষীণ!

চোখ মেলে তারে তুমি এক বার নেবে কি দেখে?
তোমার দু’-চোখ শুধু চেয়ে রবে নক্ষত্রের পানে?
কিংবা এই মানুষেরা যেইখানে ঝরে একে একে
তুমি শুধু চ’লে যাবে সেই সব মশানে-মশানে!
তোমার হৃদয় শুধু রাখিবে কি কুৎসিতের হাতে?
তোমার বুকের রক্ত ঝরাবে কি ক্রুশের আঘাতে?
তোমার ক্রুশের চিহ্ন সকল পৃথিবী দেবে ঢেকে?
এর চেয়ে বেশি কিছু আজিকার দেবতা কি জানে!

দেবতা রয়েছে বেঁচে তাই আজ- মরিবে না আর!
শেষ হবে না ক’ আর মেসায়ার মুখ থেকে কথা,
পুরানো রাত্রির মতো আসিবে না নতুন আঁধার,
মুছে দেবে না ক’ আর এ নতুন আলোর স্পষ্টতা!
কারণ এ রোদ-আলো শান্ত; সাদা সকাল-বিকাল,
পৃথিবীতে রৌদ্র তবু এক দিন ছিল আরও লাল!
সেই রক্তে আজ আর দেবতার নাই দরকার-
কারণ সে রক্তে জ্বালা আগুনের মতো শুধু ব্যথা!

সকলের মতো চ’লে আমিও হতাম ক্লান্ত যদি
আর-এক অবসাদে পরিশ্রান্ত হতাম না আর-
পৃথিবীর অন্ধকারে সব-চেয়ে পরিশ্রান্ত নদী
জানে এই পরিশ্রম?- আর জানে এই অন্ধকার?
পৃথিবীর অন্ধকারে সব-চেয়ে গভীর সাগর
খুঁজে যায় আরও গাঢ় কোনও এক গহ্বরের ঘর-
মৃত্যু এসে এক দিন দেবে তারে সকল অবধি-
শেষ হবে খুঁজিবার জানিবার দরকার তার!

কোথায় রয়েছে মৃত্যু? কোন্ দিকে? খুঁজি আমি তারে,
কোথাও রয়েছে মৃত্যু- যেইখানে তুমি আর নাই!
যেখানে তারার আলো কিংবা কালো রাতের আঁধারে
তোমারে চিনি না আর- আমি শুধু তোমারে চিনাই!
ঘুমের-চোখের ঘুম মরণের বুকের উপরে;
প্রেমিকের মতো চুমো আমার সে ঠোঁট থেকে ঝরে
মৃত্যুর ঠোঁটের ‘পরে: এক শীত-সমুদ্রের পারে
আমার জীবন পুড়ে পৃথিবীতে হয়ে গেছে ছাই!

তুমি নাই, চোখের ঘুমের মতো ঘুম হ’য়ে আছি;
বিছানায় মৃত্যু শুয়ে- তার পাশে আমি ঘুম- আমি!
মানুষীর মতো ক’রে তারে আমি ভালোবাসিয়াছি!
বিবাহের খাটের উপরে তার আসিয়াছি নামি!
বাহিরে শীতের রাত- জীবনের শীত আর ব্যথা;
ঘোড়ার খুরের শব্দ- খুরের পথের পিচ্ছিলতা!
এখানে গ্রীষ্মের রাত- আমাদের মুখে ঘাম, মাছি!
ঠোঁটে ঠোঁট, কপালের কালো চুল উঠিতেছে ঘামি!

যে কথা শিখি নি আমি কোনও দিন পৃথিবীর দেশে
এইখানে তার ভাষা আস্বাদের মতো মনে হয়।
যেই ভালোবাসা আমি পাই নাই ঢের ভালোবেসে
এইখানে শুরু হয় প্রথম সে প্রেমের সময়!
ওই দূর পৃথিবীর সুস্থ প্রেমিকেরা শুধু জানে
যে প্রেম চেয়েছি আমি- যে প্রেম পেয়েছি আমি গানে!
ওইখানে সেই প্রেম মাংস ল’য়ে দাঁড়ায়েছে এসে।
শরীরের রক্তে তার শরীরের রক্ত লেগে রয়!

এই মৃত্যু; এক দিন পৃথিবীর পথের জীবনে
বিমর্ষ হয়েছি আমি প্রেমের অনেক গল্প শুনে;
প্রণয়ের ঢের গান বিষ হ’য়ে জেগেছিল মনে-
মাছির মতন পাখা পুড়ে গেছে প্রেমের আগুনে!
আগুনের মতো প্রেম, তবুও আগুন প্রেম নয়-
মোমের মতন দেহ প্রেমের আগুন শুধু সয়!
জীবনের শীত তারে জ্বালায় নি- জ্বলেছে মরণে!
পৃথিবীর শীতে কারা ব’সে থাকে দিন গুনে গুনে!

আমিও ঘুরেছি ঢের ওই দূর পৃথিবীর শীতে,
ঘোড়ার খুরের শব্দ অনেক শুনেছি আমি কানে,
এক মুখ চিনে আর কিছু আমি চাই নি চিনিতে!
কার ভুরু খুঁজিবে, যে এক বার তার ভুরু জানে!
কার চোখ দেখিবে, যে এক বার দেখে তার চোখ!
সব মেয়েমানুষের মাঝে সেই এক মেয়েলোক!
আগুন ধরাতে জানে বরফের বুকে ব্যথা দিতে-
বরফ ছড়াতে জানে আগুনের মতো রাঙা প্রাণে!

অন্ধকারে গাঢ় সাদা সমুদ্রের মতো তার হাসি!
ক্ষুধা তার সাগরের ভিতরের গহ্বরের মতো!
আমার পিপাসা তবু তার চেয়ে গভীর পিপাসী-
ফুরায়ে গিয়েছে তবু পিপাসার সেই সমুদ্র তো!
কে ফুরাল! আহা- আহা- কেন তাহা ফুরাল এমন!
জীবনের পারে ব’সে মরণের গন্ধে ভরে মন-
ফুটেছে বিষের ফুল- নাইটশেড- তারে ভালোবাসি!
জীবনেরে কোনও দিন ভালো আমি বেসেছি কি ততো!

সিন্ধুর বুকের থেকে জেগেছিলে ভিনাসের মতো
আমার হৃদয়ে সেই সিন্ধু আছে, তার বুক থেকে!
আমার ভিনাস্ তুমি- আমি জানি, তুমিও জানো তো!
তোমারে এনেছি আমি গভীর সমুদ্র থেকে ডেকে!
আমার দু’-চোখ দিয়ে তোমারে এনেছি ডেকে আমি,
আমারে মায়াবী জেনে আমার নিকটে এসে থামি,
ঢেলেছে চুলের থেকে সাপের ফনার বিষ যতো!
তবুও তোমার চুলে রেখেছি মাথার চুল ঢেকে!

গ্রীষ্মের সিন্ধুর ঘ্রাণ রয়েছে তোমার দেহে লেগে-
সে কোন্ সাগর দূর- কেউ তার জানে না ক’ পার-
সেখানে ঘুমায়ে ছিলে পিপাসার আক্ষেপে- আবেগে!-
দরকার হ’ল তাই জাগিবার আর জাগাবার!
পৃথিবীতে এমন জাগে নি আর কোনও দিন কেউ-
হৃদয়ের রক্ত দিয়ে বানায় সে সমুদ্রের ঢেউ!
দেবতারা ঘুমায়েছে সন্ধ্যার মেঘের মতো মেঘে,
সে তবু জাগিয়া ওঠে- তার চোখে ঘুম নাই আর!

শেষের ঘুমের ঘাম কেবল কপালে লেগে আছে
অবসন্ন হ’য়ে চোখ এক দিন ফেলেছিলে বুজে-
নতুন মেসায়া এক তখন আকাশে জাগিয়াছে,
তোমার সাম্রাজ্য তুমি সেই দিন পাও নাই খুঁজে!
তোমার অবশ চোখ সেই দিন হয়েছে মলিন-
তোমার ঘুমের পর সে দিন জেগেছে নেজারিন্!
সেই হ’তে জেগেছে সে- পৃথিবী গিয়েছে তার কাছে,
তাহার বুকের ‘পরে সবাই রয়েছে মুখ গুঁজে!

সকল ঘোড়ার খুর গিয়েছে রোমের দিকে ছুটে-
সকল পেগান্ রোম তাদের পায়ের তলে পিষে
সকল পেগান্ গ্রীস তবুও ঘুমের থেকে উঠে
আবার ওঠে নি জেগে পুরানো পেগান্ সেই গ্রীসে!
কারণ নতুন আলো এনেছে নতুন এক ত্রাণ-
আর কেউ রহিবে না অ্যাপোলোর মতন পেগান্।
সমুদ্রের পাপ থেকে তুমি আর উঠিবে না ফুটে,
ফুটিবে না তুমি আর হৃদয়ের সাগরের বিষে!

তোমার চোখের পানে চেয়ে লোক হবে না মলিন,
আগুনের জিভে খেয়ে যাবে না মোমের মতো গ’লে!
এই শান্তি হাতে ক’রে আনিয়াছি নিজে নেজারিন্,
আগুনের মতো তুমি- সেই সূর্য ওঠে তবু জ্ব’লে!
তোমরা পাথর আজ, তোমরা হয়েছ আজ কাঠ!
রোমের মেসায়া সে যে, পৃথিবীর সে একা সম্রাট!
আগুনের মতো সে যে, তোমরা তাহার কাছে তৃণ-
তোমরা তৃণের মতো আগুনে-আগুনে শেষ হ’লে!

আমি তবু মেসায়ার হাত ছেড়ে আসিয়াছি চ’লে-
ঘুরায়ে নিয়েছি ঘোড়া রোমের পথের থেকে আমি,
এক দিন- এক রাত সে যে এসে বসেছিল কোলে!
তোমার মুখের থেকে সেই বুক আরও গাঢ়, স্বামী!
শুনিয়াছি- মাউন্টের ‘পরে তুমি কি কয়েছ কথা-
দেখেছি মেসায়া, আমি তোমার মুখের বিমর্ষতা!
তোমার পথের থেকে তবু আমি পড়িয়াছি স্খলে!
কোথায় চলেছি আমি- কোথায় যাব যে আমি থামি!

যাহারা রোমান ছিল মার্চ ক’রে তারা আজি যায়
তোমার রাজ্যের দিকে- তোমার ক্রুশের ‘পরে সবে-
চুমো দিয়ে চ’লে যায় চুপে চুপে বেলা-অবেলায়-
আমারও কি সেই ক্রুশে এক বার চুমো দিতে হবে?
যে ঠোঁটে আগুন আছে- যেই ঠোঁটে নাই কোনও জল
তারে তুমি করিবে কি বরফের মতন শীতল!
আমার পিছনে ও কি?- নেজারিন্, তুমি না-কি হায়!
তোমার বিষণ্ণ চোখ কত দিন চোখে লেগে রবে!

তুমি শান্তি, আর তুমি আকাশের আশ্বাসের দূত-
আমারে কি শান্তি দেবে? আনিবে কি সান্ত্বনার ছায়া!
যেখানে শিশুরা আর মাদালিন্, মেরী আর রুথ,
সেইখানে চ’লে যাও অবসন্ন আচ্ছন্ন- মেসায়া!
যেইখানে ক্রুশে বিঁধে কাঁদিতেছে মানুষের শ্বাস,
যেইখানে জন্ম লয় পাইলেট- জুডা- ব্যারাব্বাস
ভূতের মতন ভাসে তাহাদের হৃদয়ের ভূত-
সেইখানে দয়া আনো, সেইখানে আনো তুমি মায়া!

তোমার পায়ের পথ ছেড়ে তবু তুমি পলাতক,-
সবাই রেখেছে, তবু রাখি নাই মেসায়ার মান!
আমার পায়ের শব্দ হয়তো-বা শুনিছে নরক!
বধির নরক, শোনো, আমি এক অধীর পেগান্!
পৃথিবীর পথ খুঁজে পথ আমি পাই নাই কোনও,
ঘুমন্ত হীদেন্ তুমি আমার পায়ের শব্দ শোনো!
এ হৃদয়ে নাই কোনও ক্রুশকাঠ ধরিবার শখ,
পাপের হাতের থেকে চাই না ক’ কোনও পরিত্রাণ!

ক্লেশে তাপ আছে, তবু, আমি চাই সেই অভিশাপ!
সব-চেয়ে পতিতের মতো আমি কহিতেছি কথা,-
সিন্ধুর ফেনার মতো ভাসে যেই বিষ, যেই পাপ-
আমার হৃদয়ে তার অসুস্থতা; তাহার সুস্থতা!
আমি সমুদ্রের মতো আকাঙ্ক্ষায়, আলোড়নে গাঢ়!
আমারে পৃথক করো, পৃথক করিতে যদি পারো!
শীতল করিতে পারো, ক্রুশ, তুমি আমার উত্তাপ?
নির্মল করিতে পারো, নেজারিন্, এই আবিলতা?

নেজারিন্, দেখেছ কি কোনও দিন চোখ তুলে তারে?
ফলন্ত শস্যের মতো পৃথিবী গিয়েছে ভ’রে ক্রুশে!
তাদের ছায়ায় নয়,- ভিনাসের চুলের আঁধারে
হৃদয়ের শেষ রক্ত আমি তবু লইতেছি শুষে!
কারণ পতিত আমি, কোনও দিন চাই নাই ত্রাণ,
আমার শরীরে রক্ত গাহিতেছে সমুদ্রের গান!
গাহিবে সে যত দিন গাঢ় হ’য়ে গাহিতে সে পারে।
যত দিন মানুষীর অভিশাপ চাহিবে মানুষে!

তারে তুমি দেখিবে না, করিয়াছে সে কী অপরাধ?
শান্তির ঘুঘুর মতো সাদা সে কি? লিলির মতন?
ভ্যালির লিলির মতো মাংসের পাঁপড়িতে স্বাদ?-
সল্ যারে জেনেছিল- বুঝেছিল যারে সলোমন!
সমুদ্রের পারে যেই ফুল ফোটে গ্রীষ্মের বিকালে,
অনেক ফেনার গন্ধ ঘাম ঘ্রাণ যাহার কপালে,
ক্ষুধা যার গরমের সমুদ্রের মতন অগাধ-
আমার ভিনাস্ তাই!- তোমার সে লিলি কি তেমন!

কে বানাল?- বুকে তার দিল এত সাগরের বিষ!
কে বানাল তারে, আহা, তুমি তাহা জান না দেবতা!
জেনেছ কাঁটার চুমা- কাঁটায় নাই ক’ তার কিস্
তাহার ঠোঁটের ‘পরে কার ঠোঁট রয়েছে, দেখ তা!
কারণ লিলির গায় এমন থাকে কি লেগে লিলি?
শীতল লিলির স্বাদ চিনায়েছে তোমারে, গ্যালিলি!
জেনেছি কি, এক দিন জেনেছে যা গ্রীক অ্যাডনিস?
পরাজয় করেছে সে পৃথিবীর এই বর্বরতা!

এসেছে নতুন ভোর নুতন দিনের আলো ল’য়ে-
আজ কেউ গ্রীক নয়, খোঁড়া- খর্ব- চায় সব ত্রাণ!
এক দিন হয়েছে যা, গেছে তার সব শেষ হ’য়ে!
গোধূলির আলো এসে ঘিরিয়াছে তোমারে পেগান্।
অনেক শীতের রাত নামিতেছে আকাশের থেকে,
দেবতা পেতেছে ব্যথা পৃথিবীর দরিদ্রতা দেখে,
শান্তির নিশ্বাস তার অশান্তির ঢেউয়ে চলে ব’য়ে,
তাহার গ্যাবার্ডিনে লেগে আছে মঙ্গলের ঘ্রাণ!

নেমেছে শুভ্রের দিন- পেগানের গোধূলির আলো
ডুবে গেছে পশ্চিমের পাহাড়ের পিছনে সাগরে!
এই রাতে জানালায় নক্ষত্রের মতো বাতি জ্বালো,
শীতের উঠান ছেড়ে সবাই চলিয়া এসো ঘরে;
পিছনে পড়িয়া থাক যেই সব রবে প’ড়ে পিছে,-
পৃথিবীর বালকের বিস্ময়ের বিহ্বলতা মিছে!
নেমেছে শান্তির দিন, সান্ত্বনারে বাসি সবে ভালো,
মঙ্গলের দেবতার পূজা আজ করি পরস্পরে!

চার-দিকে জ্ঞান আজ- পুরানো জ্ঞানের মতো নয়;
চারি-দিকে বোধ কোন্?- আমি তার পাই না ক’ আলো,
যেই সময়েরে আর আনিবে না অসীম সময়,
অগাধ অতীতে যার সমুদ্রের সীমানা হারাল,-
আমি একা ব’সে আছি আজ সেই সাগরের পারে;
সব-চেয়ে বেশি আলো সব-চেয়ে গভীর আঁধারে
সেইখানে মিশে যায়- সেইখানে সব শেষ হয়-
তার পর, হে জিহোবা, আকাশে তোমার বজ্র জ্বালো।

আবার নতুন মাংসে তোমার পৃথিবী ফেলো ভ’রে,
রক্তের হাড়ের বীজ বিছায়ে দিতেছ তুমি পথে
নতুনের বিধানের ওই শ্রান্ত পথ ধ’রে ধ’রে
মুসার মতন মাথা দেখা দেবে ঊষার পর্বতে;
তোমার কমান্ড্মেন্ট, সেই সব অবসন্ন শোভা-
আবার দেখাবে তুমি আমাদের, বিরক্ত-জিহোবা!
কবরে যাদের হাড় আজ আর উঠে না ক’ ন’ড়ে-
সেই মৃতদের তুমি ক্লান্ত হ’য়ে দেবে তো ঘুমোতে!

তাহারা ঘুমাক্- আহা- আমিও তাদের মতো ঢুলে
ঘুমায়ে যেতাম যদি তাদের কিনারে মাথা রেখে!
আজিকার এই জ্ঞান আর এই অজ্ঞানতা ভুলে
অবসন্ন ডান হাত দিয়ে ক্লান্ত কপালেরে ঢেকে
আমিও হতাম যদি অতীতের মতন অগাধ!
সব-চেয়ে অবসন্ন! সব-চেয়ে বড়ো অবসাদ!
আজিকার এই শীত পৃথিবীর কোলে থেকে তুলে
আমারে তোমার কোলে তুমি এসে নিতে যদি ডেকে!

আজ এই পৃথিবীরে করিয়াছি আমি অস্বীকার;
আর তার জ্ঞান আমি জানিব না, শুনিব না কথা,
দেখিব আর তার আলো আমি- তার অন্ধকার;
বুঝিব না এ আলোয় আছে কোন্ নতুন স্বচ্ছতা!
জানিব না এ নতুন দেবতার কোন্ রূপ আছে।-
তাহারে যে চায় নাই তাদের সে ভালবাসিয়েছে;
আমারে যে চায় নাই আমি তবু চুমো চাই তার,
যারে আমি পাই নাই তারে খুঁজে চাই আমি ব্যথা।

তার পর শান্তি চাই- তোমার মতন শান্তি নয়!
সেইখানে আলো নাই, দূত নাই, ঈশা, তুমি নাই,
সেইখানে জিহোবার মুখে চেয়ে কাটে না সময়,
সময়ের বুকে শুয়ে সেইখানে সময় কাটাই?
তোমার ড্রামের শব্দে এক দিন উঠিবে কি বেজে!
ডুম্সডের ড্রাম-ট্রামপেট তারা ভুলে গিয়েছে যে!
যেই ঘুমে ক্লান্ত কপালের ঘাম ভুলে যেতে হয়,
সেই ঘুম- আমি শুধু পেগানের সেই ঘুম চাই!