আগুনের গান

ক্রমেই আমের কুঞ্জ অধিক মুকুলে আরও ভারি হয়ে ওঠে
আঞ্জিরের শাখাগুলো আকাশের দিকে চ’লে গেছে
বিচিত্র, বিভিন্ন ঋজু অগ্নির মতন
বাতাসের সিঁড়ি বেয়ে ভোরের মুনিয়া-পাখি আকাশের পথে
কোনও এক দ্বার চায়
সুদূরে সূর্যের বিম্বে পবিত্র নারীর দেহ যেন
প্রকাশিত হয়ে ওঠে- ধীরে-ধীরে সকলের তরে
পাখির হৃদয় তবু আমুন্ডসেনের মতো উঠে
ঊর্ধ্ব- আরও ঊর্ধ্বতর আকাশের অভিক্ষেপে এসে
প্রতিটি খাঁজকে শুধু মুহূর্তের ক্যাম্প ব’লে ভাবে
তবু এক শ্যাম মার্জারীর মতো স্ফীত বাতাসের বিভা
সাপিনির নির্জন বিস্ময়ে চেয়ে আছে
এই পাখি সম্মোহিত বেতালের মতো
উলঙ্গ কঙ্কাল মেলে চ’লে যায় গগনের কাছে?
সেখানে কে আছে?
সে কি শুধু কামানের গুলির মতন
অথবা বেলুনবাজ মাতালের ঊর্ধ্বে আরোহণ
দু’-চারটে মদের বোতল, বই, সিগারেট, দেশলাই, কামাতুর দস্তাবেজ নিয়ে
অথবা সে নিয়ন্ত্রিত মেধাবীর মতো দূর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে
প্রশান্ত হৃদয় মেলে চুপে-চুপে যেতেছে হারিয়ে

পৃথিবীতে বেঁচে থেকে ঢের দিন আমি
দেখে গেছি বহুতর জিনিসের ঊর্ধ্বে গমন
আইকেরাস গিয়েছিল এক দিন
মধ্যযুগে সিলফ, পরি, জিন, স্যালেমেন্ডার, স্তম্ভ, লোষ্ট্র, চিল, পণ্ডিতের মন
সর্বদাই পৃথিবীর এক দ্বারে প্রকাশিত হয়ে
আকাশের অন্য দুয়ার দিয়ে অলোকসামান্য নিঃসরণ
জেনে গেছে-
তার পর টানাপোড়েনের ছাঁকা সুতো হয়ে অবলীলাভরে
মিশে গেছে তারা সব সাধারণ কাপড়চোপড়ে।
ছুটে গেছে বালকের হাত থেকে ঢিল
কর্নিস ভেদ ক’রে উড়েছে দলিল
জ্যামিতির রেখা গেছে শূন্যের ভিতরে- ইশারায়
গোধিকার উঁচু মুখ উপরের আগুনকে খায়

টেবিলে সোনার মূর্তি স্বর্গ রসাতল আসে ঘুরে
অত্যধিক ধূর্ততায় চেয়ে থাকে মনীষীর চোখোচোখি নিটোল দুপুরে।
আছে বটে। তবুও অনেক আগে চ’লে গেছে উড়ে

ডাইনামো ব্যাঙের মতো ব্যাপ্ত শব্দ করে
তীর্ণ এরোপ্লেনের মনীষা
ক্রমেই নিজেকে আরও উজ্জ্বল করে না কি হে হোরবেলিশা
পাইসরেস্তোরাঁতে আমি চায়ের পেয়ালা নিয়ে ব’সে
সর্বদাই চেখে গেছি অগণন চাখড়ির মতো শুষ্ক মুখ
ভিড়ে-ভিড়ে ধূলপরিমাণ সব প্রত্যর্পিত হলুদ চিবুক
কোমরে দু’ হাত রেখে এই সব উড়ুনিকে তারা
উড়ায়ে দিয়েছে হেসে-হেসে
দেখেছে অতীব গভীর নির্বিশেষে।
তাহাদের সকলেই সায় দিয়ে মাথা নেড়ে স’রে গেল- তবু- তার পর-
তাহাদের মাঝ থেকে এক জন ব’লে গেল এই:
অনেক দালাল ঘেঁটে পৃথিবীতে সব-শেষে ইস্পাতের জেপেলিনে চ’ড়ে
মৃত পিতৃপুরুষের পরিত্যক্ত প্রতিশ্রুতি নিলামের ঘণ্টায় অধিকার ক’রে
ঠেকেছি নক্ষত্রে গিয়ে
মৃগশিরা জলসৰ্প স্বাতী সরমায়
সর্বদা প্রদীপ্ত ভোর সেইখানে
আমাদের পৃথিবীর প্রভাতকে প্রস্তুত গাপ্পির মতো পেয়ে
এক গাল ম্লান জল দিয়ে গিলে খায়
তবু সব মৃত বয়স্যের ভিড়
মৃত সন্তানের ভিড়
দু’ দিকের কানে হৃষ্ট টুপির ভিতরে স্নিগ্ধ চাঁদিনির মতো গোল শির
সেই লাল আগুনের রঙে এসে নিজেদের শরীরের ম্লান প্যারাফিন
ক্রমে-ক্রমে ক’রে তোলে শ্বেত- দীপ্ত- অত্যন্ত রঙিন
হরিণের কণ্ঠে যেই গান আসে বাঘিনির মুখে ধরা প’ড়ে
সে-রকম বড়ো আগুনের গান গায়।