এক জন বাংলার চাষা

অইখানে দাঁড়ায়েছে এক জন বাংলা’র চাষা
কার্তিকের বিকেলের অবশিষ্ট আলোড়িত রোদে
এখন গাছের ঊর্ধ্বরেখা (কোনও) এক বিড়ম্বিত পাখির হৃদয়ে
স্মরণীয় দিবসের শেষ হেঁয়ালির মতো- একাকী মাঠের দিকে চেয়ে
তাই সে রয়েছে ব’সে- কথা ভেবে- অথবা অনেক কথা ভাবিবার কিছু
হৃদয় পাখির নেই- ঝাউয়ের শাখার ‘পরে আলোড়িত বিবর্ণ দোয়েল
হয়তো নির্মল এক মনিবের কুকুরের লোমের ভিতরে
সাধু ইটিলি’র মতো সারা-দিন উষ্ণতার স্বাদ
উপচিত ক’রে নিয়ে- এখন কিছুটা হিম
অথবা সে আমাদের চেয়ে এক স্বতন্ত্র জগতে
আমাদের পরিচিত ভয়াবহ নদীর উপর দিয়ে চুপে
অনায়াসে হেঁটে গিয়ে- (পায়ে তার বিভিন্ন খড়ম
রেখেছে সে)- সর্বদাই আমাদের হৃদয়ের সমান্তরালে
চলেছে রেখার মতো- অনুভব ক’রে আমি স্পর্শ ক’রে নিতে
হৃদয় বাড়ায়ে দিলে- তবুও কোথাও স্পর্শ নেই।
আবছায়া-আলোকের ভিতরে একাকী
হামাগুড়ি দিয়ে চুপে উড়ে গেল মাঠের ফাটলে
আধেক আড়ষ্ট এক কৃমিকে উৎকীর্ণ ক’রে নিতে।

মাঠের উপরে অই কিষানের মাথার উপরে
ম্লান কাপড়ের ফালি- বিকেলের জাফরান রোদে
কিছুটা আশার কাছে ধরা দিল হয়তো-বা- তবু সে-মানুষ
মাটির ভিতরে তার প্রত্যাশাকে মুলো, ব্যাং, মৃত্তিকার চাকা
মৃত ইঁদুরের মতো এক দিন পেয়েছিল ব’লে
এত শত শতাব্দীর পরে আজ- এ-রকম বিকেলবেলায়
কোথাও রঙের কাছে- সূর্যের রঙের কাছে আজ
স্পর্শাতুর নয় আর- (কেননা সে) দুই চোখ বুজে নিয়ে বিশ্বাসীর মতো
আলাদা হৃদয় তার- তাই সে সমস্ত দিন নিকটের নদী
কী ক’রে জলের শব্দে প্রবাহিত হয়ে যায় শুনে
কিছুই শোনে নি তবু, (জানি আমি), মানুষের অন্য অবধারণার পথে
কিছুটা কৃমির মতো হয়ে গেছে- মৃত্তিকার অন্ধকার নাভির ভিতরে
কেউ তাকে বিজড়িত ক’রে দিয়ে চ’লে গেছে- আমাদের আলো
জন্তুর হাতের থেকে কেড়ে নিয়ে- সমুজ্জ্বল টেবিলের থেকে
সর্বদাই অনুভব ক’রে গেছে মৃত্তিকার অন্ধকার নাভি, লাঙ্গল, কোদাল
মানুষের কিছু নয়- তাই সে কিছুই নয় আজ আর
মানুষের। আমাদের ধারণার সক্রিয়তা অকপট মায়াবীর মতো
দেখেছে মৃত্তিকা- ফুল- শুনেছে নদীর শব্দ পাখির মতন
মির্মিরের কথা বলে- এঞ্জিন শান্টিং করে- কারেরা পাথর
নিবিড় মিনার হয়ে গ’ড়ে ওঠে- আপনার ভিন্ন প্রতিভায়
মৈত্রেয়ী মৃত্যুকে জয় ক’রে তবু হয়তো-বা ফ্রয়েডের কাছে
লিবিডো’র অবতার। উজ্জ্বল দিনের গল্প এই সব ক্ষিতিজ রেখায়
অন্য এক (সমুজ্জ্বল) দূর মিছিলের।
এইখানে বাতাসের মর্ম ব’য়ে শুধু এক অন্ধ প্রতিধ্বনি
ওর পাগড়িতে এসে লেগে থাকে- যখন সে এত দিন পরে
পুনরায় আবিষ্কৃত হয়ে গেছে সময়ের শেষ নিরূপণে
জন্তুর মতন আজও- ন্যূব্জ, ম্লান কোদালের ‘পরে
অন্তরঙ্গ হাত রেখে- এইখানে- এখনও মানুষ
কাজ ক’রে যায় ধীরে- তবু এই অবিচল অপূর্ব প্রতীতি
নিজের সীমার শেষ বীট’এ এসে দাঁড়ায়েছে ব’লে
এখন সে বস্তুতই ভয়াবহ ভাবে একা
মানুষ ও নিসর্গের প্রত্যাখ্যাত অন্ধকার দ্রব্যের মতন।
(তবু এই অবিচল প্রতীতির থেকে
আসন্ন দ্বন্দ্বের জন্ম হয়ে যাবে-
নরক দেখে নি কোনও দিন।)