আর এক বার

আর এক বার সেই ফাল্গুনের ধূপের নিশীথে
নক্ষত্রের খানিকটা নিচে
যখন আমার দেহ রাঙা হয়ে তার পর আঁধারে নিভিছে
কোনও এক পরিচিত ঢের দূর নিচু পৃথিবীতে;-
নক্ষত্রের খানিকটা নিচে
কবোষ্ণ দুধের মতো উপরের থেকে যেন বাতাস নামিছে

মনে হল;- আমার নতুন দেহ ঘিরে যেন অনুমেয় অপরূপ ক্ষুধা
আরও এক বসন্তের বাতাসের
পৃথিবীতে কোনও দিন এই স্বাদ পাই নাই টের
যেন ঢের জামরুল-উপবন, সাদা নদী, মর্মরের সিঁড়ির বসুধা
অগুরুর গন্ধে ডেকে নিয়ে যায়- কোনও প্রাসাদের
তবুও সে-সিঁড়ি ছেড়ে বাতাসের নির্বাচনে ফিরে যাই ফের

আমি সে-প্রাসাদ ফেলে সারসের মতো একা নক্ষত্রের তলে
সংক্রামিত বাতাসের সাথে
যেইখানে প্রত্যুষের জন্ম আর হয় না ক’ চির-আধা-অন্ধকার রাতে
নবীন বুনন নাই যেইখানে- চিরকাল একখানা মোম শুধু জ্বলে
যেখানে জ্ঞানের ক্ষোভ সুপক্ক ফলের মতো ধীরে-ধীরে ঝ’রে পড়ে হাতে
ক্লান্ত হয়ে; শান্তি আছে;- এই ভেবে সারসের মতো গ্রীবা-প্রেরণা বাড়াতে

কবেকার প্রতিধ্বনি- যেন বিন্ধ্যপাহাড়ের পাথর-বিবরে
শুয়েছিল বহু দিন
ফাল্গুনের অন্ধকারে ঘনিষ্ঠ তারার পথে শুধিতে আসিল তার ঋণ
বিদেশিনী ধাত্রীরে ছেড়ে দিয়ে যেন তার জননীর স্তন্যের তরে
এল শিশু অন্ধকারে- বিছানায়- কালো চোখ ক্ষোভে সমীচীন,-
গভীর ঝাউয়ের শব্দে কবেকার এক খণ্ড পৃথিবী নবীন

আমারে স্পর্শিল যেন আকাশের সীমাহীন সমতল পথে
যূথচারী পাখিদের ভিড়
সাদা মেঘ থেকে দূরে ধূসর মেঘের দিকে উড়ে যায় যখন নিবিড়
মৃত্যু পাছে দয়িতেরে ফেলে দেয় ক্ষমাহীন কর্কশ পর্বতে
এই ভয়ে সঙ্কুল মেঘের বুকে হৃৎপিণ্ড রেখে দিয়ে শ্বেত পাখিনীর
দেহ যেন মানবীর আত্মা পায় বেদনার বিদ্যুতে অধীর

তেমনই ব্যাকুল ঠোঁটে ফিরিল সে মোর দিকে সেই দূর শূন্যের ধূসরে
যেন সব সমগামী পাখিদের দল
উড়ে গেছে ঢের আগে- পাখিনীর প্রেমিক কেবল
পিছে প’ড়ে আছে ব’লে- আরও দূর নীলিমার ঢালু খেতে স্বর্ণশীর্ষ নক্ষত্রের ফসলের তরে
তার কোনও স্বাদ নাই- মুখ যেন নিমীলিত উপাসনাময়ী এক মানবীর মতন বিহ্বল
মেঘের স্তরের পরে সাদা স্তর শব্দহীন- মরণের পরে যেন আরও মৃত্যু- ডানার কৌশল

ব্যোমচারী পাখিনীর প্রেম যেন হরিতেছে;- শিমুলের তুলা বুঝি নিম্নে পৃথিবীতে
উড়ে যায় ফাল্গুনের পরিপক্ক রাত্রির বাতাসে
এখানে ঈশ্বর তার মেঘ আর নক্ষত্রের শুক্ল বহির্বাসে
ব’সে আছে নিরীশ্বর- যেন সৃষ্টি ধূসর কেশর শুধু জাদুঘরে সিংহদের- একটি ফলের শব্দে মাটিতে পড়িতে
কেউ নাই এইখানে- অনুপম হাওয়া সব দূর গ্রহে অন্ধকার পৃথিবীর মূঢ় মধুমাসে
চ’লে গেছে;- ধবল মেঘের এই পরলোকে কোনও দিন যেন কোনও ঋষি নাহি আসে

কোনও দিন যেন, প্রিয়, বলিল সে, পাই না ক’ কোনও ব্রহ্মস্বাদ
এই গাঢ় স্তব্ধ পীঠে- সে-ও কোলাহল
অন্তর্যামি, মুমুক্ষার জন্য মোর নাহি কোনও সাধ
(বলিল সে) দুই দিকে দুই স্তর লক্ষ-লক্ষ চমরীযূথের মতো সাদা মেঘ ঘুমাতেছে- আমরা দ্বিদল
প্রেমের বীজের মতো এইখানে- হে বিধাতা, আমাদের দাও তুমি এই প্রেম- মাংস- অমাংসল

এইখানে নাই আর জ্ঞান-অক্ষি-গোলকের মতো ক্লান্ত সূর্য আর চাঁদ
এখানে সময় আর খেলে না ক’ পাশা
একটি বিড়াল রেখে পাশে তার মূঢ় ইন্দুরের তরে ক্রূর ভালোবাসা
রাজকন্যা দেখায় না এইখানে- নতুন মাটির গন্ধে হয় না ক’ নবতর শস্যের আবাদ
সোনালি নিবিড় ধান আছে ব’লে- জ্যামিতির স্মৃত রেখা ভেঙে ফেলে কর্কটের উচ্ছৃঙ্খল ভাষা
মানবের চেতনাতে জাগাতেছে পৃথিবীতে অন্ধকার শেষ নদী-বনিতার চুমার প্রত্যাশা

‘আমি সেই গোপনীয় নদীটির হিম উপাধান থেকে উঠে
সময়েরে ফাঁকি দিয়ে, প্রিয়া,
অবিরল নক্ষত্রের সমতল মধুকূপী-ঘাস-পথ দিয়া
বকের ছানার মতো আধাে-ভয়ে আধাে-উড়ে-‘ শিহরিয়া শুনিল সে- ‘এসেছি প্রাণের পক্ষপুটে’
বলিল ঈশ্বর তবু: ‘তোমরা নির্জন পুচ্ছ হয়ে র’বে আমার এ-নিরিচ্ছা ব্যাপিয়া’
মেঘের প্রস্তরখণ্ডে স্তব্ধ ক’রে রেখে দিল তাহাদের দু’জনার হিয়া।