বালক-কালের দিনগুলো

বালক-কালের সেই মূল্যহীন, অপরাধহীন সাদা দিনগুলোর থেকে
আজও এই আয়ুর বিপথে ফিরে- অন্ধকারে- আমার হৃদয়
বার-বার নগরীর ঘ্রাণে নাকে তুলে নিয়ে- তবু
সস্মিত আমোদে তাহা এক বার- আধ বার- প্রত্যাখ্যান ক’রে
মাথার উপরে এক নির্মেঘ আকাশের নীলের দিকে চেয়ে থাকে
অথবা যেখানে মেঘ জড়ো হয়- দু’-চারটি- তৌলের ‘পরে
নির্মল তুলার মতো- এমনই নিয়ম তবু মৌন নিসর্গের
আমাদের সব ক্রেন- ধূমা- রক্ত- ইস্পাতের চেয়ে
ভারি তাহা; অথবা সে-সব মেঘ উড়ে যায়- খয়েরি, করুণ
চিলগুলো (যদিও তাদের প্রাণ বাজারের বিনিময়ে দিতে
খানিক ইচ্ছুক তারা- তবুও খানিক তাহা আকাশের)- আমারও হৃদয়ে
অন্য এক পরিসর এনে দেয়- কখনও বাষ্পের গন্ধে আমি
চেয়ে দেখি নদীর নিকটে এসে দাঁড়ায়েছি- এইখানে জল
মানুষের আধো-ব্যবহিত এক ভিন্ন প্রতিভার
আওতায় প’ড়ে গিয়ে নিজেকে অভিজ্ঞ ক’রে নেয়
(আজ ভোরে- দু’-পহরে- অথবা তিমির রাতে গিয়ে)
কেননা সৃষ্টির পথ সর্বদাই নবীন, নতুন প্রক্রিয়ার
দাগ দিয়ে আপনাকে কেটে নিয়ে নিজের আলোক
অনুমান ক’রে নেয়- নিজের পর্যাপ্ত অন্ধকার
নিরূপণ ক’রে দেখে- এই গাঢ় হুগলি’র জল
আমার হৃদয়ে এক নতুন মুখের প্যারাডিম
উদ্বোধিত ক’রে দেয়- খানিক রক্তিম তাহা, ধূমায় মলিন
তেলের ন্যক্কারে ক্লান্ত, লশকরের মূঢ় তামাশায়
অথবা ব্যথায় বিষ- চারি-দিকে দীর্ঘ নগরীর
কবন্ধের মতো হিম পরিপ্রেক্ষণীর তালে প’ড়ে
এখানে সে নির্ঝরের মতো এক শিশু
নয় আর। কোথাও নিক্বণ নেই। হিরাচাঁদ খেমকা’র
ভালো লেগে যেত- মানুষের সক্রিয় শরীর
তুষের মতন খুলে- তবুও পিঙ্গল জলে শুশুকেরা আজ
নীরবে লাফায়ে উঠে নদীর এ-সব কথা জানে
যখন ভোরের সূর্য ভাসমান নোঙরের ‘পরে
অথবা তাদের ভিজে মসৃণ পিঠের উপরে জ্ব’লে উঠে
নিভে যায় নক্ষত্রের নিরুপম রাত্রির অঙ্গারে

কোথাও সাধিত কিছু হয়ে যায়- আকাশ, নক্ষত্র, নদী, সৃষ্টি আমাদের
শত শতাব্দীর সাথে বেড়ে উঠে এখন এ-অসময় সময়ের পথে
আমাদের আরক্তিম মূঢ় নগরীর চেয়ে তবু বড়ো
নয়। অথবা তবুও কিছু মহত্তর হয়ে তারা আজ
নিজেদের পরিচয় শুদ্ধতর ক’রে নেয় মানুষের চোখে
ধরা প’ড়ে- মানুষকে ধ’রে ফেলে- যেমন জননী
ঈষৎ রুপালি চুলে টান খায় ডানপিটে সন্তানের হাতে
সহসা নৃত্যের মাঝে যে-রকম গাধা- গাধাবোট
সমূহ তাউসটাকে চেয়ে দেখে চোখের সম্মুখে
কোথাও মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় হয়তো-বা- অথবা ঘড়ির
সময় ঘড়ির পানে- হয়তো চালক তার শুধু লবেজান
অন্ধকার- উজ্জ্বলতা- তবু এই- তবুও বালির ঘড়ি অন্ধকারে বেজে
ব্রহ্মাণ্ডের ঘড়িটিকে চিনে নেয় ব’লে তারা পরস্পরের প্রপূরক।