বিচিত্র এক পৃথিবী

এখানে বিচিত্র এক পৃথিবীতে দাঁড়ায়েছি এসে
সর্বদাই চারি-দিকে নিসর্গ ছড়ায়ে আছে- তবু
আজ ভোরে মনে হয় ধবল ঘোড়া’র পিঠে চ’ড়ে
এখানে এসেছি আমি নিচু এক আকাশের নির্জন প্রদেশে
যত দূর চোখ যায় বধির জন্তুর মতো ভেসে
দূরে এক অরণ্যের রেখা জাগে হয়তো-বা ধূর্ত কুয়াশায়
অথবা তা ধূম্র মিনারের ভিড় অন্য এক নগরীর গায়
সেখানে আমার ঘোড়া এক দিন গিয়েছিল
তবুও নিস্তব্ধ আছে আজ এই মাঠের ভিতরে।
সে-দেশের কোনও এক মৃত রূপসির চুল- আরও ম্লানিমায়
এখন এখানে প’ড়ে ঘোটকী’র লেজ হয়ে যায়
দুইটি ভারুই পাখি আকাশে সূর্যের দিকে উড়ে যায় একা
তার পর আরও এক-জোড়া পাখি ধবল শল্কে জ্ব’লে উঠে
বেলুনের নাবিকের মতো ঊর্ধ্বে উড়ে
আমার হৃদয়ে এক সঞ্চারিত আনন্দের ছবি
তবুও অঙ্গার দিয়ে আলোড়িত ক’রে গেল পুড়ে

প্রান্তর ছড়ায়ে আছে শ্যাম হয়ে প্রান্তরে-প্রান্তরে
তাদের উপর দিয়ে লক্ষ পথ চ’লে গেছে-
কোনও পথ মৃগশিরা-নক্ষত্রের তরে
কোনও পথ কুহুলিন নদীটির দিকে
কোনও পথ প্রবালের মতো এক সমুদ্রের পানে
কোনও পথ জন্ম মৃত্যু মৈথুনের দিকে এই সাদা ঘোড়া
ঘোড়া’র উপরে এই প্রতিভূকে টানে
ভৌতিক রেখার মতো বৈকুণ্ঠের দিকে চ’লে গেছে এক পথ
কোনও পথ ঋজু হয়ে আপনাকে গণিতের তুলাদণ্ডে মাপে
ঐ সব পথে গার্গী- প্যাসকাল- নাগার্জুন গিয়েছিল এক-দিন-
সেই সব নামে আজও পৃথিবীর জনপদ কাঁপে
ঢের আগে বামনের মতো ক্ষুদ্র কনফুশিয়াস একা গিয়েছিল অন্য এক পথে
হরিতকী-অরণ্যের বর্তুল ফল-ভরা রৌদ্রময় চীনের পর্বতে
কোনও পথ নেমে গেছে চাঁদের শিঙের নিচে যেইখানে একা এক প্রাংশু দানব
সর্বদাই অন্তরীক্ষে করে এক মেনকা’র ঘ্রাণ অনুভব

নিকটে নিঃশঙ্ক নদী ব’য়ে যায় তাবিজের মতো ঘুরে বালির ভিতরে
হয়তো-বা আমলকী-কুঞ্জ থেকে দু’-একটা পাকা ফল জলের ভিতরে
ঝ’রে পড়ে- নদী তারে সাপের মুখের মতো উঠে গ্রাস করে
অথবা সেখানে কোনও কুঞ্জ নেই আজ রাতে আর
কোনও দিন ছিল না-কি সেই কথা লুপ্ত আজ নিসর্গের মনে
কোথাও জননী নেই এ-নদীর- পরিধির মতো ঘুরে- ফুলে-
রমণীর ভিজে কাপড়ের মতো তার উত্থাপিত স্তনে
জন্ম দেয় না আর এখন সে কোনও ক্ষুদ্র শাবকনদীর
নিজের জলের শব্দ শুনে-শুনে কান তার রজকের গর্দভী’র মতন বধির
হয়ে গেছে- আকাশে ঈশান কোণে সর্বদাই থাকে যারা- তাদের খোঁচায়
নীরব, নিশিত কোনও নৃশংসতা এখন লাগে না তার গায়ে
পৃথিবীর বিদূষকদের দাড়ি- ক্লান্ত কপালের ভাঁজ পালিশ পয়সা হয়ে যায়
তাহার জলের স্পর্শে- তবু কোনও জনপ্রাণী পেচক চাঁদের আলো ভুলে
কোনও দিন ছায়া ফেলে না ক’ এই নদীর বিবরে
সুদূর ধারালো চাঁদ ভয়ে উত্তেজিত হয়ে এই নদীর ভিতরে
অসমসাহসী এক ভীরু বালকের মতো পিঙ্গল নিক্বণে ধরা পড়ে

বিষুবক্রান্তির রাতে কাটা সব ফসলের মতো হাড়গোড়ের আলোকে
দানব সে চেয়ে থাকে- বালকেই চেয়ে আছে দানবের চোখে
নেউলধূসর ঝরনা দেবদারু-ছায়ার ভিতরে করে রোল
পাহাড়ের পাথরের কবলে সে প’ড়ে গেছে- চির-দিন-
ভালোবাসে তবু সেই কালো কুকুরের মতো শীতল কবল
কেননা সেখানে কঙ্কাল এক সর্বদাই চাঁদের অনলে
সহসা দানব হয়ে জেগে ওঠে- কেঁদে ওঠে মৃত পৃথিবীর জাদুবলে।