বিস্ময় এক অনুভব ক’রে

হৃদয় বিস্ময় এক অনুভব ক’রে যেতে
এসেছে এ-পৃথিবীতে
আমিও অনেক আরও মানুষের মতো
নির্মিত হয়েছি ঢের পিতৃপরম্পরাদের
ঔরসের থেকে নেমে অন্ধকার দিনে
ক্রমে-ক্রমে অবয়বে পূর্ণ হয়ে- তবুও সর্বদা
কিছুটা আকাঁড়া থেকে যেতে- অনেক সময় তাই
নিজেকে প্রাণীর মতো অনুভব করি আমি।
উড়ে চ’লে যাই স্বচ্ছ বোলতার মতো
স্ফটিক পাখনা মেলে ফাল্গুনের রোদে
নিজেকে উপুড় ক’রে জেনে নিতে গিয়ে
সর্বদাই বড়ো এক অববাহিকায় এসে বাবলার ডালে
সোনালি ফুলের মতো মুখ তুলে মদির বাতাসে
জ্ব’লে উঠি- বৃক্ষরাও মাথা নাড়ে- নদীরাও
অনুমোদনের সুরে ভেসে যায় সমুদ্রের দিকে
বড়ো নীল মুখ তুলে পরস্পরবিচ্ছিন্ন পথের
দানবীয় ভ্রাতাদের মতো যেন সমস্ত সমুদ্র
এক ফুট আলোর ভিতরে এসে জড়ো হয়
সমস্তই নীল যেন- পরিহাস, ব্যথা, অভিজ্ঞতা
শুশ্রূষা, আনন্দ, স্বাস্থ্য- দানবীয় নীল।

তখন বোলতা তার দেহের অবশ ভ্রম থেকে
সহসা বিমুক্ত হয়ে টের পায় শরীরের
নিবিড় হলুদ রং- ভাস্করের যন্ত্রে কাটা শৌখিন আবের
দুইটি নির্জন ডানা- বিস্ময়ের প্রথম পাথর
কোনও এক এক-মাত্র নিরাময় গ্যাজেবো’র।
হয়তো-বা নিজের হৃদয়ে ডুবে অবশেষে এক দিন ওসেনোগ্রাফিস্ট
সমুদ্রকে মাপ করে- পৃথিবীর ঘড়ির মুহূর্তে
ব্রহ্মা’র আয়ুর স্বাদ অবিকল অনুভব ক’রে।

প্রান্তরের পথে ফিরে প্রতিটি প্রাণীর দিকে চেয়ে
শ্রদ্ধা জাগে তার পর- আমার পায়ের কাছে ঢিল
লোষ্ট্র, শন, মাঠের ফাটল, জল, কানসোনা ঘাস
হয়তো-বা ব্লাভাস্কি’র চেয়ে স্থিরতর
গল্প জানে, বেহালা’র ধোপার গাধা’র চেয়ে ঢের
মৌলিক তামাশা; চোরাবাজারের পঞ্চ ঘুমন্তের চেয়ে
সুস্থতর ঘুম তবু রয়ে গেছে ইহাদের-
একটি স্বপ্নকে পেয়ে সর্বদাই দিবাস্বপ্নহীন।

আমরা চাখড়ি নিয়ে টেবিলের ‘পরে
দাগ কেটে কথা ভাবি- অথবা চৌকশ, গোল টেবিলের দিকে
জড়ো হই- কখনও-বা অন্ধকার ঘরে শুধু একটি নিমীল
চর্বির আলো থাকে- কখনও-বা সমস্ত প্রাসাদ
বৈতরণী নদীর ফেরির মতন অন্ধকার;-
আমাদের পরস্পরের হাত আঙুলে বিভক্ত হয়ে হাতে
লেগে থাকে- মনে হয় মনীষীর শলাকার মতো যেন
কিংবা কোনও কৌতূহলী গোধিকা’র মতন রক্তিম
প্রতিটি আঙুল যেন পৃথিবীর প্রথম রক্তকে
জ্বালায়েছে এক দিন;- আগ্রহে থামায়ে রেখে দেবে
আমাদের শেষ নাড়িনক্ষত্রকে আপনার অভিজ্ঞতায়।

আমাদের টেবিলের নিচে এক তুষের আধার
অন্ধকারে জ্ব’লে যায় নিজের নিয়মে
অথবা কিছুই নেই- তবুও ধুনোর আঘ্রাণ
পর্দায় নিনাদিত হয়ে ওঠে তৃতীয় প্রহরে
ব্লাভাস্কি’র সাথে ব’সে আমরাও অনুভব করি সব
তবুও কৌশল ব’লে মনে হয়- এখানে কিছুই সৃষ্টি নয়
বিস্ময় অনৃত নয়- তবু সেই ভাবানুগ, অভিজ্ঞ জীবন
মানুষের নিজের জিনিস- ঘাসে- দিবালোকে
নগরীর গুনাগারে- অগণন ভিড়ের ভিতরে
সেখানে তাসের খেলা নেই কিছু- হুডিনি’র
বিসদৃশ চাল নেই। তবুও প্রতিটি মুখে আমার বিষয় রয়ে গেছে
মানুষেরা হেঁটে যায়, কথা বলে, ভুল করে, প্রেমের ভিতরে
সজারু-পিণ্ডের মতো সহসা প্রবেশ ক’রে ব্যথা দেয়
শঙ্কিত মাংসের মতো গোল হয়ে গড়ায়ে-গড়ায়ে
বিখ্যাত আমোদ তারা- নিজেদের নীড়ের নিকটে
প’ড়ে থাকে- সজারুর কলমের খোঁচা খেয়ে আমি
তাকেও কুঞ্চিত ক’রে রেখে দেই জীবন্মৃত্যুর মার্গে চির-দিন
অথবা টেবিলে তার মাংস চ’লে আসে
কিংবা আমাদের সব সামন্তনীতিকে
টিটকারি দিয়ে তারা অন্ধকার সুড়ঙ্গের নিচে
প্রেম, শান্তি, আলোকের রাজ্য গড়ে লেনিনের মতো।

কিংবা শহরের পথে যেন নীরবে চলেছি
ম্লান ফুটপাত থেকে দুই হাত দূরে স্থবির গাধা’র উপরে
হাতে ছিপ, গায়ে গলাবন্ধ কোট- দরিদ্র পকেটে
মাছের চারার ঘ্রাণ- তবুও প্রতিটি মুখ ফুটপাতে
ট্রাম- বাস- রিকশায়- অধিক অভিজ্ঞতর
আমার এ-হৃদয়ের চেয়ে অধিক শঙ্কিত তাই
তবুও আমার চেয়ে সহজেই প্রতীকের দ্বারে
প্রত্যভিগমন ক’রে অন্য দ্বার দিয়ে
বার হয়ে চ’লে যায়-
তাদের গায়ের রং ধূসর জলের বীজে বুদবুদিত
মুখের খোঁড়লে সব জলখুশি সাপের মতন বিমর্ষতা
অথবা ব্যাঙের মতন সর্পাতঙ্ক- সর্বদাই নহুষ নদীর
জলের মুখোশ, লোল গুল্মের কিনারে হেঁটে-হেঁটে
তবুও প্রতিটি মুখ জলথুপি সাপের মতন।
পরস্পর বিজড়িত হয়ে তারা ছুটে যায় খাদকের মতো
ক্ষুধায়- অথবা প্রেমে- রিরংসায়- হাই তুলে
মুহূর্তেই রূপান্তরিত হয়ে যায় খাদ্যের মতন তবু
কৃষ্ণদাস পালের মূর্তির কাছে কোনও এক ব্যাং
সহসা সর্পের মতো হেসে ওঠে বড়বাজারের
অন্যায় গলির রঙে- টেরিটিবাজারে ঢের ভেক
স্থূল হয়ে গেছে ভেবে অগণন সাপ
তাহাদের খেয়ে ফেলে পবিত্র নির্মল
ব্যাঙের প্রাণের ভয়- ইচ্ছা হয়ে
নির্জন মলিন মুখে চতুরাস্র আলোর ভিতরে
দেখা দিল এসপ্লানেড’এ

যেন এই কলকাতা পরিমিত সমুদ্রের মতো
সর্বদাই উদ্বোধিত হয়ে ওঠে গতির ভিতরে
মৃত্যুও মৌখিক যেন- তামাশাও
অকৃত্রিম বিপন্নতা এই দিকে আজ

নানা পথে ভ্রান্ত হয়ে ঘুরি আমি তার পর
অনুভব ক’রে দেখি আমার পকেটে
চারা নেই- কী ক’রে তা হলে মাছ ধরা যাবে ভেবে
তাকাতেই দেখা গেল হলুদ বিষণ্ন চোখে সাপ
তুচ্ছ এক ব্যাঙের দেহকে মুখে রেখে
সততই আত্মচিন্তা ক’রে তবু কিছু
কিছুই করে না গ্রাস- কোথাও প্রসাদ নেই পৃথিবীতে।
আমি সেই সাপের মাথার ‘পরে গাধা
নীরবে চালায়ে নিয়ে চাপ দিতে ব্যাং
নিবিড় সবুজ ব্যাং বার হয়ে নেমে এল আলোর ভিতরে
নেমে এল; মাছের আদার তবে এ ছাড়া কে হবে আর ভেবে
জীবন্মৃতকে তুলে পকেটের ছোট টিনে ফেলে
অগ্রসর হতে গিয়ে দেখি সেই জলখুশি সাপ
নিজের মুখের গ্রাসে প্রবঞ্চিত হয়ে এই পৃথিবীর নিরীহের মতো
বধির বিষণ্ন মুখে চেয়ে আছে আমাদের দিকে।
তাই আমি শীর্ণ সরীসৃপটির ক্ষুদ্র মুখের ভিতরে
‘চাদিনি রাত্রি’ নামে বোতলের মদ ঢেলে দিয়ে
তাহার মসৃণ শল্কে মেখে দিয়ে গেলাম খানিক
পন্ডস ক্রিম- সিনথেটিক নারীদেহ- যোনি-
তাহার মুণ্ডের ‘পরে দিনার-রঙিন কাগজের
একটি বিখ্যাত টুপি এঁটে দিয়ে অন্তর্হিত হলাম দু’ জনে
আমি ও আমার গাধা নগরীর শেষ গ্যাসপোস্ট
ছেড়ে দিয়ে- মাঠ ছেড়ে- ঘুমুলিন নদীটির দিকে
সবুজ সজীব ব্যাং বড়ো শীতে ফুঁড়ে নিয়ে তবে
সেখানে গাধার পিঠ থেকে ঝুঁকে জলের ভিতরে
ছিপ ফেলে চেয়ে আছি নিসর্গের নিমীল আগুনে
একাকী উদ্ৰিক্ত এক কৃকলাস আত্মার মতন
পৃথিবীতে যা হয়েছে- যা হতেছে- অথবা যা হবে
সেই সব ঘটনার কেন্দ্র থেকে তবু কোনও সুর
বার ক’রে নিয়ে আমি শিস দেব কোনও এক মূর্খ সম্রাটের
পিঞ্জরে নিবদ্ধ কালো যুগল পাখির মতো নেচে
অত্যধিক মনীষায় মূঢ় হয়ে গেছে ব’লে মানে
হাসি নেই- বিদুর ও সঞ্জয়ের রক্তের ভিতরে
এক ফোঁটা নিগূঢ় ভাঁড়ামি ছিল কোনও দিন?

শোলা’র ফাতনা ন’ড়ে ডুবে গেল দেখে আমি প্রগলভ আলোয়
ছিপ টেনে তাকাতেই সব-চেয়ে আগে
বিখ্যাত টুপির মুখ দেখা দিল- জলখুশি সাপ
সবুজ সজীব ব্যাং মুখে ক’রে গৃহিণীর অমায়িকতায়
নিজেকে খসায়ে নিল কাঁটার ভিতর থেকে চুপে
বিদ্বেষে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি অগণন
জলখুশি হাজির হয়েছে ক্ৰমে বৃত্তের মতন
নির্মেঘ আভাসে ঘুরে- সকলেরই মুখে ব্যাং- আমাদের চোখে
চেয়ে আছে। প্রতিটি বিমর্ষ মুখে সবিশেষ কিছু
চায় না ক’। আমার গাধা’র খুরে কখন ধর্ষিত হবে তাহাদের মাথা
তাদের মুখের থেকে জীবন্মৃত ব্যাং
বার হবে;- এই শান্ত অনুহৰ্ষ তাহাদের
বাকি সব গভীর গুজব তারা শুনে গেছে বাতাসের আগে।