বহু দিন পৃথিবীর পথে

‘বহু দিন পৃথিবীর পথে ঘুরে জীর্ণ আরও হতেছে হৃদয়-‘
বললাম চুপে আমি চোখ তুলে, ‘আকাশের নক্ষত্রেরা হয় যেন ক্ষয়-
পৃথিবীর পুরোনো সে সাদা পথ মুছে যায়, তবুও হৃদয়ে ছিল আশা
আমাকে খুঁজতে তুমি; কখনও তোমার ভালোবাসা
ফুরোবে না; তবু তুমি ঘাসে শুয়ে অন্ধকারে ডাহুকের গান
শুনে বুঝেছ যে-ধাতু দিয়ে শরীর ও প্রাণ
হয়েছে এ-পৃথিবীতে, তা কেবলই অনাদি ধাতু নয়
ক্লান্তি আর গ্লানি তাকে ক্ষয়
ক’রে ফেলে-‘ ‘আমি-‘
এইটুকু ব’লে চুপে চোখ বুজে বহু ক্ষণ রইল সে থেমে
বিষণ্ন ঘাসের ‘পরে; ঢের দূরে ঝুরুঝুরু ক’রে ওঠে বেউড় বাঁশের বন সব
তার পিছে কার্তিকের বাঁকা চাঁদ- নীলাভ নীরব
হলুদ অশ্বত্থপাতা খসখসে ঝাউফল উড়ে-উড়ে থেমে থাকে ঘাসে
নক্ষত্রের মুখ ঢেকে কেমন কুয়াশা লেগে রয়েছে আকাশে
মৃদু বাতি বুকে নিয়ে ধুলোয় একসা সাদা পথে
গোরুর-গাড়িটি কার শান্ত অপেক্ষার মতো এই সন্ধ্যার জগতে
লেগে আছে;
‘এক দিন আকাশের নক্ষত্রও যায় না কি ক্ষ’য়ে-‘
খোঁপা ভেঙে বললে সে কালো চুলে আচ্ছাদিত হয়ে;
যেই সনাতন রাত্রি মানুষের চেষ্টা মুছে ফেলে ভালোবেসে
তার মুখোমুখি এক দ্বিতীয় রাত্রির মতো এসে
বিছিয়ে রয়েছে এই সৃষ্টির গণনায় তেমনই নির্ভুল;
হৃদয়ের মৃত্যু যদি হত তবু অন্তহীন অমৃতের মতো এই কালো এলোচুল-

এ-বার শান্তির গল্প-
শান্তি এই পৃথিবীতে খুব ধীরে আসে-
বহু ক্ষণ চুপ ক’রে রইল সে মাঠের বাতাসে
পেয়ারা জামের পাতা উল্কার মতো যেন ঐ দুর অন্ধকারে ঝরে
দু’-চারটে শেয়াল সটকে যায়; চোখের ঘুমের মতো মৃদুতায় মাঠের ভেতরে
সজনে’র গুড়ি ঝরে কুয়াশায়, ঘাসে, মৃদু ঝিঁঝিদের গায়
শুকনো নিমের পাতা উড়ে চুপে তাঁতের শাড়ির ‘পরে পড়ছে বিছিয়ে
সবের বুকের ‘পরে এসেছে বসন্ত আজ- শান্তি আজ এনেছে বেদনা
সলতের বুক জুড়ে স্নিগ্ধ আলো যে-রকম শোকাহত আগুনের কণা
ধ’রে রাখে নিরন্তর-
বিনুনি বাঁধল ধীরে এক বার, বিনুনি খসাল ফের-কয়েকটা কাঁটা বেতফল
কুড়োলো আঙুলে তার; শাড়ির ভিতর থেকে চোরকাঁটা খসাল কেবল-
আমার প্রেমের সত্ব হেঁটমুখে ক্ষয়
ক’রে সে নিজের ধর্মে কেমন নিহিত হয়ে রয়-
আমার হৃদয় সব অবিনাশ জিনিসকে নাশ
ক’রে হতে চায় তবু এ-নারীর নশ্বর আকাশ।