বৈতরণী (সংযোজিত)

কী যেন কখন আমি অন্ধকারে মৃত্যুর কবর থেকে উঠিলাম
আমারে দিয়েছে ছুটি বৈতরণী নদী
শকুনের মতো কালো ডানা মেলে পৃথিবীর দিকে আমি উড়িলাম
সাত-দিন সাত-রাত উড়ে গেলে সেই আলো পাওয়া যায় যদি
পৃথিবীর আলো প্রেম?
আমারে দিয়েছে ছুটি বৈতরণী নদী।

সাত-দিন শেষ হল- তখন গভীর রাত্রি পৃথিবীর পারে
আমারই মতন ক্ষিপ্র ক্লান্ত এক শকুনের পাল
দেখিলাম আসিতেছে চোখ বুজে উড়ে অন্ধকারে
তাহারা এসেছে দেখে পৃথিবীর সকাল-বিকাল
ক্লান্ত-ক্লান্ত শকুনের পাল!

সুধালাম: ‘তোমাদের দেখেছি যে বৈতরণী-পারে
সেইখানে ঘুম শুধু- শুধু রাত্রি- মৃত্যুর নদীর পারে, আহা!
পৃথিবীর ঘাস রোদ মাছরাঙা আলোর ব্যস্ততারে
ভালো কি লাগে নি, আহা!’- শুধালাম-
শকুনেরা শুনিল না তাহা,
ডুবে গেল অন্ধকারে, আহা!

এক জন র’য়ে গেল- বিবর্ণ বিস্তৃত পাখা ঘুরায়ে সে মাঝ-শূন্যে থেমে:
‘কোথায় যেতেছ তুমি? পৃথিবীতে? সেইখানে কে আছে তোমার?’
‘আমি শুধু নাই, হায়, আর সবই র’য়ে গেছে- সকালে এসেছি আমি নেমে
বৈতরণী: তার জলে;- যারা তবু ভালোবাসে- ভালোবাসিবার
পৃথিবীতে রয়েছে আমার!’

খানিক ভাবিল কী-যে সেই প্রাণ- ক্লান্ত হ’ল- তারপর পাখা
কখন দিয়েছে মেলে বৈতরণী নদীটির দিকে;
বলিলাম: ‘ঐ দেখ- দেখা যায় তমালের হিজলের অশথের শাখা
আর ঐ নদীটিরে দেখা যায়- আমার গাঁয়ের নদীটিকে’
চ’লে গেল তবু সে-যে কুয়াশার দিকে!

তারপর সাত-দিন সাত-রাত কেটে গেল পৃথিবীর আলো-অন্ধকারে
আবার চলিছে উড়ে একা-একা শকুনের কালো পাখা মেলে
পৃথিবীতে তাহাদের দেখিয়াছি- আজও তারা মনে ক’রে রেখেছে আমারে
ভালোবাসে;- রক্ত-মাংসে থাকিতাম তবু যদি- আমার এ-সংসর্গের ভালোবাসা পেলে,
রোজ ভোরে রোজ রাতে আমারে নতুন ক’রে পেলে

তাহারা বাসিত ভালো আরও বেশি- আরও বেশি- এই শুধু- আর কিছু নয়-
সাত-দিন সাত-রাত তাহাদের জানালার পর্দায় উড়ে-উড়ে কেবল ভেবেছি এই কথা
আবার পেতাম যদি সে-শরীর- সে-জীবন- তা হ’লে প্রণয় প্রেম সত্য হ’ত; আজ তা বিস্ময়
আজ তা বিস্ময় শুধু- শুধু স্মৃতি- শুধু ভুল- হয়তো কর্তব্য-বিহ্বলতা:
সাত-রাত সাত-দিন পৃথিবীতে কেবলই ভেবেছি এই কথা।

তারপর মৃত্যু তাই চাহিলাম- মৃত্যু ভালো- মৃত্যু তাই আর এক বার,
বিবর্ণ বিস্তৃত পাখা মেলে দিয়ে মাঝ-শূন্যে আমি ক্ষিপ্র শকুনের মতো
উড়িতেছি- উড়িতেছি;- ছুটি নয়- খেলা নয়- স্বপ্ন নয়- যেইখানে জলের আঁধার
বৈতরণী- বৈতরণী- শান্তি দেয়- শান্তি- শান্তি- ঘুম- ঘুম- ঘুম অবিরত
তারই দিকে ছুটিতেছি আমি ক্লান্ত শকুনের মতো!