দানবীয় কপাল

দানবীয় কপালকে দেখা যায় মনে হয়- বাকি সব সময়ের কুয়াশায় ঢাকা
সে-দানব আশ্চর্য সূর্যের মুখে এসে প’ড়ে ভোরে
আপনাকে চক্ষুষ্মান জীব ব’লে টের পায়
শূন্য খোঁড়লের মতো অপরূপ চক্ষুহীনতায়
কপালের বলিরেখাগুলো সব অভিজ্ঞ নদীর মতো বেগে
প্রভাতের বাতাসের আলোড়নে মকরপুচ্ছের মতো ঘোরে

আমাদের দেশে ঘুম ভেঙে গেল- সকলের
হাজার জাতক চাকা পার হয়ে আর এক বার
অবিস্মরণীয় নীল গঙ্গা’র কিনারে
সেইখানে ভোরবেলা নিশীথের মতন আঁধার
চতুরাস্র সীমানার হাড়োলে সেখানে মুণ্ডিত মাথা সব
নিমেষে অনন্ত কাল পার হয়ে আসে
যেন কেউ তাহাদের পিছে ছুটেছিল
ক্রূর কুকুরের মতো ঊর্ধ্বশ্বাসে
তবু তারা কুকুরের ছায়ার মতন
সর্বদাই সারমেয়-শরীরের আগে ছুটে যায়
যত দিন সূর্য আছে- সূর্যের পূর্ণগ্রহণ
রয়ে গেছে নক্ষত্রালোকিত পৃথিবীতে
যত দিন আয়ুকুকুরের মতো কেউ ঘুরে যায় অনন্তের শীতে
তাহারা ছায়ার মতো অকপট শঠতায় ক’রে আসে পরিধি ভ্রমণ

গঙ্গার উপর দিয়ে পুনঃপুনঃ বিবর্তনময়
ব্রহ্মাণ্ডের পরিধির মতো গোল
স্মৃতিপরম্পরাদের জন্ম হয়
নদীর পিঙ্গল জল ঘুরে গিয়ে
অপস্রিয়মান ভীত মানুষকে দেখে
শানিত সূর্যের রঙে অন্ধকার নদীর শরীরে
তাকে নিয়ে আসে ডেকে
সাপের পুচ্ছের মতো ঘুরে যায় শল্কময়, নীল কালো জল
যেন ভূমা স্থির এক চিতাবাঘিনির মতো পাতালের নিচে
তাকে ঘিরে হিংস্র হয়ে ওঠে শীঘ্র দুরন্ত ছাগল

লক্ষ-লক্ষ যুগ ধ’রে নিজেকে মুখস্থ করে স্মৃতি
নদীর কিনারে সব গুল্ম উদ্ভিদের প্রাণে আনে ভীতি
নিজেও সে একা ধরা প’ড়ে গিয়ে হয়ে ওঠে ভীত
প্রতিটি মানবমুখ মাংসাশী পাতার মতো
অন্ধকার উদ্ভিদের মতো যেন-
প্রতিটি নৃশংস গুল্ম- অন্ধকারে-
পরিচিত মানুষের মুখ ব’লে হয়েছে স্বীকৃত

গঙ্গার স্মৃতির জলে প্রভাতের কপিশ আলোয়
নগরীর থেকে সব সরমা’রা জড়ো হয়
ছিপছিপে সারমেয়দের শীর্ণ স্রোতে
সূর্যের স্তিমিত মোম ঘেরা এক অববাহিকায়
লক্ষ যুগ পরে তারা জন্মেছিল
এখনও পাটল জলে তাদের কুপিত মুখ নড়ে
নেপথ্য- কুণ্ঠিত হয়ে উঁকি দিয়ে তাহাদের মুখ
দেখে গেল-
প্রথম মাংসের খোসা উঠে গেছে- তার নিচে বার হয়ে রয়েছে চিবুক
অসংখ্য সন্তপ্ত ঠোঁট উদ্ভিদের অনুকৃতি নিয়ে
জলের ভিতরে নিচে- আরও নিচে- যেতেছে হারিয়ে
সূর্যের আলোর লোভে ধূসর কর্দমে পুনরায়
ধীরে-ধীরে উঠে আসে নাড়িনক্ষত্রের ধূর্ততায়
কিনারার মৎস্যডিম বুদবুদের মতো
ঠোঁট নেই- মুখাবয়ব নেড়ে গুল্মদের মতন সতত
পরিহাস ক’রে যায় পৃথিবী- সমুদ্র- সূর্য
অন্ধকার- আলো- আয়ু
নিজেদের আগেকার জীবনের বিস্মৃতিকে ক্রমে
পরিণত হয়ে যায় নদীর কিনারে ঘাস গাজরের দাড়ি-গোঁফে
চতুর মূর্তির শালগমে

পুনরায় তারা সব গঙ্গাতীরে মানুষের মতো
দাঁড়ায়েছে ঋজু সূর্যে এসে
তাদের বাণীর রূপ ঋণমুক্ত হতে গিয়ে- হৃদয়ের ভুলে
কুকুরের- ক্যানারি’র মতো রোল তুলে
সকল আবহ ঘুরে ফিরে আসে পুনরায়
মৃত্তিকার মাংসময় নদীর উপরে।
সময়কে ফুরাবার স্পৃহা
সীমানাকে ডিঙাবার তাপ
খাদের মুখের স্থূল মুখোশকে রেখেছে নিষ্পাপ
সহসা সূর্যের রঙে- মুহূর্তের অবলীলাভরে
কুকুরের মতো সব- তাহাদের ভিজে শরীরের থেকে কুকুরের মতো
আবিল জলের সূপ পুনরায় নিমেষেই ঝরে

এ-সব উদ্যম দেখে হৃদয়যন্ত্রের পরিতাপে
মাংসাশী উদ্ভিদগুলো হেসে ওঠে নদীর কিনারে
মানুষের মতো হাত তুলে দিয়ে বাতাসের গায়ে
মানুষের মতো মুখে ছবি ফেলে জলের ভিতরে
অথবা সকল রূপ এক এই পৃথিবীতে- জেনে-
নর-নারীদের সব অন্তহীন জানুহীন দেহ
স্তনাকার লালসার অবয়ব ধ’রে
নদীর জুসের কাছে কিনারার উদ্ভিদের মতো
গঙ্গা’র স্মৃতির জলে এসে ধরা পড়ে।