এই সব পাখি

সারা দিন পাখিগুলো কোন্ আকাশ থেকে কোন্ আকাশে থাকে!
কলকাতার শহর যেন পাখিহীন হয়ে থাকে:
পাখিদের আমি সব চেয়ে বড়ো ক্যাপিট্যাল মনে করি;
জুটমিলের মালিকদের মতো অন্য রকম-
কিন্তু কলকাতা কি শুধু জুটওয়ালাদের?
কলকাতা আমাদের,
এবং কলকাতা- কলকাতাও পাখিদের।
কলকাতার আকাশে চৈত্রের ভোরে যেই
নীলিমা হঠাৎ এসে দেখা দেয় মিলাবার আগে
এইখানে সে আকাশ নেই;
রাতে নক্ষত্রেরা সে রকম
আলোর গুঁড়ির মতো অন্ধকার অন্তহীন নয়।

তবুও আকাশ আছে:
অনেক দূরের থেকে নির্নিমেষ হয়ে
নক্ষত্র দু’-এক জন চেয়ে থাকে;
চেয়ে থাকে আমাদের দিকে-
যেন টের পায়
পৃথিবীর কাছে আমাদের
সব কথা- সব কথা বলা
ডাভেন্ট্রিডোমেই টাসে স্টেফানিতে
যুদ্ধ শান্তি বিরতি নিয়তির ফাঁদে চির দিন
বেধে গিয়ে ব্যাহত রণনে
শব্দের অপরিমেয় অচল বালির
মরুভূমি সৃষ্টি ক’রে গেছে;
-কোনও কথা কোনও গান
কাউকেই বলে নাই;
কোনও গান
পাখিরাও গায় নাই। তাই
এই পাখিহীন নীলিমাবিহীন সাদা স্তব্ধতার দেশে
তুমি আর আমি দুই বিভিন্ন রাত্রির দিক থেকে
যাত্রা ক’রে উত্তরের সাগরের দীপ্তির ভিতরে
এখন মিশেছি।

এখন বাতাস নেই- তবু
শুধু বাতাসের শব্দ হয়
বাতাসের মতো সময়ের।
কোনও রৌদ্র নেই, তবু আছে।
কোনও পাখি নেই, তবু রৌদ্রে সারা দিন
হংসের আলোর কণ্ঠ র’য়ে গেছে;
সারা দুপুর পাখিগুলো দূরের থেকে আরও দূরে
কোথায় চ’লে যায়!
শহর দরিদ্র হয়ে পড়ে।
শহর নির্জন হয়ে পড়ে।

ধীরে ধীরে বিকেলের নরম আলো
নরম আলো পৃথিবীতে নামে;
ভিস্তির জলে তখন রাস্তা ঠাণ্ডা,
রাস্তায় ছায়া;
ব্যস্ততা তখন কম- আরও কম;
পাখিদের তখন পৃথিবীতে নামবার সময়;
রোদের রঙ তখন পেঁয়াজি,
রোদের রঙ তখন সোনালি,
রোদের রঙের সময় শুধু তখন;
ক্লাইভ স্ট্রিটের জানালাগুলোও সচকিত হয়ে ওঠে;
পৃথিবী কোন্ জিনের সমুদ্রের ভিতর চ’লে গেল!

পাখিরা তখন আকাশ থেকে নামে,
বলে তারা: ‘এমনতর কলকাতায় থাকতে পারা যায়;
এই সন্ধ্যার সমুদ্রে
আমরা গোলাপের পাপড়ির মতো খ’সে পড়ছি।’

অনেক ক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে দেখি আমি
চার দিকে পাখনা পালক;
পালক আর পাখনা
কলেজের উঁচু-উঁচু দেবদারু গাছের ভিতর ঘুরে যাচ্ছে;
দেবদারু পাতার ফাঁক দিয়ে সোনার ডিমের মতো সূর্য,
রূপোর ডিমের মতো চাঁদ,
শিশির ঝরছে;

কলকাতা?
কলকাতা!

কৃত্তিবাস। আষাঢ় ১৩৮০