গভীর শীতের রাতে যেন থার্ডক্লাসের বাঙ্কে
আমিও রয়েছি শুয়ে
কোথায়-যে যাব আমি জানি না ক’ কিছু
যেন এই পৃথিবীর ট্রেন নয়
ভৌতিক গতি যেন- শব্দহীন
স্বাদহীন শূন্য দেহ-
কোনও এক বায়ুসরীসৃপ যেন নামিতেছে নিচু
পাহাড়ের শৃঙ্গ বেয়ে- শৃঙ্গ বেয়ে-
পাথর-চাঙাড় যেন গুঁড়ো ক’রে
সরীসৃপ-দেহ তার অন্ধকারে যেন শুধু ঘোরে
পুচ্ছের পিছনে
তবুও চেকার নাই- টিকিট নাই
নিগূঢ় ঠিকানা যেন এক দিন আপনারে ভাবিয়াছে
তার পর যেন স্ফূর্ত ভ্রাম্যমাণ ইহুদির মতো
বিষুবরেখার সাথে গোল হয়ে ঘুরিতেছে
যেই সব ডোডোপাখি ম’রে গেছে পৃথিবীতে
তাহাদের খুঁজিতেছে চির-দিন-
অন্ধকার: যেন কোনও পাড়াগাঁ’র বণিকের সুবিশাল ভাঁড়ারের মতো
যেইখানে একে-একে সব ভাই সব বোন মরেছে তাহার
জনক-জননী গেছে- সব ছেলে সব মেয়ে ম’রে গেছে তার
তার পর কতগুলো সাদা-সাদা পাথরের বাটি আছে-
কবেকার রেকাবিতে এখনও রয়েছে পাতক্ষীর
কোথাও আবৃত হয়ে রয়েছে পনির
কয়েকটা ফুটি যেন মসৃণ পেটে শুয়ে ঘুমাতেছে
কবেকার তরমুজ-ঘ্রাণ যেন চুপে-চুপে চাখিতেছে মশা’দের মিষ্ট ব্যবহার
চারি-দিকে নির্বাপিত দীপগুলো ধূসর মঠের মতো যেন
সব ঘিরে ব’সে আছে বয়স্কা বধূর মতো যেন এক নির্বাচিত রাতের বাতাস
পাথরমূর্তির ভগ্ন স্তনে তার ধীরে-ধীরে অঙ্কুরিছে পরগাছা- ঘাস
তাহার ফাটলে যেন ছায়া ফেলে অরণ্যের অলস গোগ্রাস
পুরোহিত-বনিতার মতো যেন ঘুমাতেছে নিশ্চিন্ত আঁধার
কোনও দিন যেন কিছু আলোড়িত হবে না ক’ আর।
তবুও করিব আমি সব আলোড়ন
ভেবে আমি উঠিলাম- যেন কোনও জননীব স্তন
ছিঁড়ে আমি দুগ্ধ খাব-
ঘুমাবার আগে আমি- কোণঠেসা শিশুর মতন…
একটি কম্বল চাই- শীতে ন্যূব্জ দেহ
কোনও এক অবসন্ন গণিকার কথা যেন মনে হল- পৃথিবীতে দেখিয়াছি কবে
প্রখর বন্দুক তার কাঁধে ফেলে- তাহারে হাঁটিতে যদি দিতে পৃথিবীতে
অ্যামেজন হত না সে- জানি আমি- হেঁট নাকে তবুও নীরবে
তোমরা পুরুষ আর সে রমণী ব’লে জীব কত কাল শরীরের হাস্যাস্পদ হবে?
তাহারে কম্বল দাও- শাল দাও- তবুও সে শুষ্ক- শুষ্ক হয়ে যাবে তামাশার শীতে
এইখানে বাঙ্কে শুয়ে জননীর দুগ্ধ ফেনা- তিব্বতের ভেড়াদের উষ্ণ লোম চাই কেন তবে!
আহা, মনে হয়,
জীবনের যুদ্ধ যেন ভৌতিক, পৌরাণিক নয়।
বহু দূরে চ’লে গেছে যেন আরও ধূসর সময়
নিজে চ’লে?- কে তাহারে নিতেছে চালায়ে?
‘জ্যামিতির দৌত্যক্রিয়া এসে যেন অবশেষে শৃঙ্খল বাঁধে না তার পায়ে
পাখি তার- ধনেশপাখি কি তার ঠোঁট দিয়ে ঘ’ষে ফেলে দেবে হিমালয়?’
বলিল সময় চোখ পাল্টায়ে;- দেখিলাম বলিচিহ্নহীন তার ত্বক
হরিৎ উজ্জ্বল রূপ- সময়: সে গাঢ় বিদূষক
পৃথিবীতে জনমজুরের মতো দেখেছি যাদের
ফাঁসিকাঠে- ভূমিকম্পে- রক্ত আর পীত সমুদ্রের পারে- যুদ্ধে- দুর্ভিক্ষের
অন্তরালে যাদের পেয়েছি আমি টের
তারা যেন অরণ্যের অণ্ড সব- শ্বেত দেহ- বলিতেছে হ্রেষারবে হেসে
আঁধার খোঁয়াড়ে থেকে বহু দিন- ঘায়ের মাছির সাথে যুদ্ধ ক’রে
হেরে গিয়ে- ম’রে গিয়ে- তাই অবশেষে
আমরা এসেছি এই সীমাহীন সমতল নক্ষত্রের খেতে-
এই গাঢ় মেঘ-শ্বেতপারাবত-পুচ্ছময় দেশে
এইখানে ব্র্যাডম্যান বল যদি ছুঁড়ে মারে বাতাসের সাথে তাহা ভেসে যায় লক্ষ-লক্ষ মাইল নিরুদ্দেশে
তোমারেই, হে সময়, আমিও করিব তবে ক্ষয়
সঞ্চয় করিব আমি দূর শস্য সময়ের
নীহারিকা- ধূমকেতু- গ্রহে-গ্রহে- রৌদ্রময় তার্পুলিন তাম্বু বেঁধে আমি
বাবুইপাখির মতো হোগলায় মৃত্তিকার নীড় গড়ে আজ
দাঁড়কাকদের মতো ঢের মিথ্যা কলরব লুফে- লুফে- লুফে- সারা-দিন
একটা গভীর কিছু নেব আমি- শ্লেষ্মা নয়- ক্লেদ নয়- কোনও এক নাক্ষত্রিক তৃণ
যেমন চাহিছে তারা- তাই আর ক্লান্তি নাই তাহাদের স্মরণীয় ঠোঁটে
দূর মেঘগুচ্ছ থেকে কিছু পাবে, কিছু যেন পাওয়া যাবে
রাশি-রাশি ঝোড়ো কাক ওড়ে তাই আর্তনাদ ক’রে এক জোটে
কোনও এক ঝটিকার অবসানে- ধৌত নীল মধ্যশূন্যে।
সারা-দিন চামারের পাড়া ঘুরে- পাড়া ঘুরে
শুয়ারের মতো আমি- মতো তুমি- অসহিষ্ণু ক্ষুধার্তের গুলির হুঁচোটে
মাংস হয়ে প’ড়ে র’ব- ঝুলে র’ব শূন্য হয়ে- তুমি আর আমি
এই ব্যথা নিষ্ফলতা তবু কারু বুকে লাগে-
তাই দূর মেঘ থেকে নামি
সিংহদ্বারে দাঁড়াবে সে একা এসে (অগণন দেবদূত পাঠাবে না মোটে)
আবার উঠিব তাই- নব রৌদ্রে- সময়ের ধূর্তহীন বোটে
মক্ষিকার মতো মোরা উড়ে যাব
(মধু যদি ঘরে নাহি থাকে, প্রিয়, চ’লে যেতে হয় দূর পাহাড়ে-পাহাড়ে
উঁচু মঞ্চে গাঢ় তরমুজ-ঘ্রাণ- হে বামন, প্রতিবাদী সময়ের ঘাড়ে
তোমারে চড়াবে কেউ- মহীয়ান- মক্ষিকা-ঝঙ্কারে
যদিও রুধিবে তারে পৃথিবীর প্রধান আঁধার
জননীর- ভগিনীর রূঢ় অহঙ্কার
লাথি মেরে- শঠ ব্যবহারে
বার-বার অন্ধকারে- তারে;)
গভীর শীতের রাতে
বায়ু-সরীসৃপ যেন নামিতেছে নিচু
যেন সব পৃথিবীর সেনাপতি- তরবার- দণ্ড- মুণ্ড- কেতু-
সব কাজ শেষ ক’রে- ভেঙে ফেলে নগরের বন্দরের সেতু
সরীসৃপ-পেটে ঢুকে ঘুমাতেছে
আমারে উচ্ছিষ্ট দাও পৃথিবীর রুগ্ন এক সারমেয়-প্রসূতির মতো
এ পার্বণী নগরীর
আজ আঁজলায় জল দাও- হাইড্রেন্ট খুলে দিয়ে
তবু দাও খানিকটা স্থূলতম ইন্দ্রিয়ের হাসি
যেন এই পীত তামসিক দাঁতে অন্ধকারে ওঠে তা উদ্ভাসি
এই-মতো ঘুমাবেই ডোরাকাটা বাঘ আর পিঙ্গল-রঙের সিংহ ভেঙে ফেলে
রক্ত আর কড়ি আর কঙ্কালের সেতু।
তখন সিংহের সাথে অনেক হরিণ এসে রৌদ্রনীলিমায় ব’সে জানিবার হেতু
খুঁজে পাবে;- সেই দিন মৃত সব হরিণের পিতা আর দুহিতার স্মৃতি
ভেবে-ভেবে নীল অশ্রুজলে তার কেশর উঠিবে, আহা, তেতে।
সেই দিন অনুকম্পা- সেই দিন প্রেম হবে জমকালো ব্যাঘ্রের অতিথি
অরণ্যের মধ্যরাত্রে- কালো মেহগনি-বনে মোমের মতন
উডকাটে-আঁকা যেন আবছায়া রহস্যের ব্যাঘ্র আর বন
প্রীত হবে শিশু আর প্রেমিকের মন।