হে নাবিক

হে নাবিক, হে নাবিক, বন্দর অনেক দূরে আছে না-কি? ঊষা ঢের দূরে?
অনেক নক্ষত্রে ভ’রে আছে ঐ নীলিমারা- মেঘ নাই- বাতাসের অনুকূল রব
শোনা যায়;- এই সব শান্ত স্পষ্টতার থেকে তবু মরণের জন্ম হয়
হয়তো-বা পৃথিবীর আদি যুগ থেকে মানব হৃদয়ে
মরণের নিস্তব্ধতা রয়ে গেছে ব’লে;

হে নাবিক, মৃত্যু কোনও জীবনের অসম্ভ্রম নয়, অশালীন বিষণ্নতা নয়
রজনীর জল- উদ্গীরণ ক’রে সময়ের চাকা ঘুরিতেছে ধীরে
যাত্রীরা ঘুমায়ে আছে- তাদের আত্মার ‘পরে
সুপ্ত নিশীথের মৃত প্রেমিকারে ফিরে পেয়ে
এই নীল- এই মৌন স্নিগ্ধ বাতাসের হাত থেকে
অপার্থিব উপঢৌকনের মতো যেন- হে নাবিক,
চারি-দিকে স্ফুট নক্ষত্রেরা- কোথাও বন্দর নাই, ঊষা নাই, আর
এই পরিষ্কার মহনীয় নিশীথের পীঠে শুয়ে তারা জানে:
পৃথিবীর আদি যুগ থেকে মানব হৃদয়ে
মরণের নিস্তব্ধতা র’য়ে গেছে
আমাদের আকাঙ্ক্ষার অভিমুখ-
পৃথিবীর পুরজ্যেষ্ঠদের
দেউলিয়া দোকানের নব- নবতর শঠতার তরে নয় আর
বহু পরিক্রমা ক’রে তাই যখন জীবন তার নিজ-কক্ষে ফিরে আসে
হয়তো ধূসর বই নিয়ে মোমের আলোর কাছে- হয়তো-বা রমণীর মুখে চেয়ে
হয়তো সূর্যাস্ত দেখে, হয়তো-বা শিশুদের কালো চুল নিয়ে প্রভাতের রৌদ্রে খেলা ক’রে

কোনও জাদুঘরে লম্বিত কঙ্কাল দেখে অবলুপ্ত হাঙরের- অথবা তিমি’র
মানব হৃদয় যেন সময়ের ঘড়ি স্তব্ধ এক নিষ্ঠা খুঁজে পায়
কোনও এক পৌরাণিক ধীর বিচারের থেকে উঠে এসে
নির্জন মৃত্যুর দূত কাঁধে হাত রাখে আমাদের
যেন এক প্রিয়তমা ধর্মযাজিকার মতো অনুভব নিয়ে
গভীর শান্তির বায়ু খেলা করে যেন ভীরু অনিচ্ছুক রক্তের ভিতরে;
কোনও দূর কলরবময়- রক্তময়- প্রবাদের থেকে ফিরে এসে
স্বজনতমের দারুচিনি-ভরা অন্ধকার- স্তব্ধ প্রকোষ্ঠকে
শরীরের অপরূপ মাংসকে তার- ভালোবাসি না কি আধো-ভয়ে
আধো-বেদনায়? হে নাবিক, হে নাবিক, মৌন মধ্য-সমুদ্রের!

স্ফটিকের পাত্রে জল, প্রভাতের রৌদ্র নিয়ে আমাদের অন্তরের অভিমুখ
নতুন জীবন পাবে এই পুরোহিত গাত্রী মরণের কোল থেকে উঠে
উচ্ছন্ন বৃক্ষেরা যেন তাহাদের অন্ধকার স্তম্ভিত কোটরে
হরিৎ হাওয়ার শব্দ পাবে;
তক্ষকের শুষ্ক দেহ
কঙ্কাল-কঞ্চির মতো গুঁড়ো ক’রে
বহিছে বাতাস যেন;
নির্জন- পবিত্র- এক বিলাপের মতো উঠে এসে
জলের জননী যেন তরুদের বিশৃঙ্খল ছিন্ন কাঠে
জ্যোতিষ্কের সম্ভাবনা গ্রথিত করিতে আছে
পৃথিবীর গলিত উদ্যানে গিয়ে কাগজের ফুল নিয়ে খেলা করিবার
আহ্বানে বধির হয়ে স্থির- অভঙ্গুর জ্যোতি পাব
রুধিরে গভীর এক ধূমাহীন শান্তি আছে ব’লে।