হেমন্ত-রাত

আবার চেয়ার থেকে উঠে- ব’সে- উলের বুনুনি ভুলে গেল ব’লে
‘নতুন শেখার কিছু আছে না-কি আমাদের পরিপৃক্ত সূর্যের নিচে-‘
‘হয়তো-বা কোনও এক আমোদিত দার্শনিক বলেছিল রক্তের আলোড়নে মেতে
ঢের আগে;- আমিও রক্তের তাতে ব’লে যাই সব
কারণ অনেক দিন- পৃথিবী ও নরকের ঘটনাচক্রের
সন্নিবেশে কান পেতে থেকে তবু নতুনকে পাই নাই টের-‘

এখন হেমন্ত-রাত এসে গেছে- এই নগরীর থেকে চুনো
জনরবে ক্লান্ত সব মানুষের এখন গুটায়ে নিতে হবে
চেয়ে দেখ- কুয়াশায় সকৌতুকে গলা টান ক’রে নিয়ে হরিয়ালগুলো
যত পারে নগরীর চিমনিকে দূরে রেখে- অজ্ঞাতে- এড়িয়ে
চ’লে যায়- তুমিও এমন যাবে আকাশের কোনও এক ছাঁকা গ্রামপথ দিয়ে
রুধিরের সংস্কারে নিট হয়ে- যেখানে পৃথিবী গিয়ে অবশেষে দক্ষিণ সাগরে
মিশে গেছে;-
সমুদ্র সমাপ্তি চায় পৃথিবীর কাছে
পৃথিবী সমাপ্তি চায় সূর্যের নিকটে
সূর্য সমাপ্তি চায় ব্রহ্মাণ্ডের পারে যেইখানে;-
আমাদেরও চেয়ে বেশি অসমাপ্তি রয়ে গেছে সেই সব নিসর্গের প্রাণে?

জল নেই- একটি গেলাস নেড়ে রেখে দেই টেবিলের ‘পরে
কে যেন চুরুট খেয়ে চ’লে গেছে
প্রবীণ, পার্থিব গন্ধ ঘরের ভিতরে
বাহিরে অনেক নিচে খোলার ঘরের থেকে আর সকলের
অন্য-রূপ ধোঁয়া ভেসে আসে
মৃত, ক্ষুদ্র,- ক্ষুদ্র,- ক্ষুদ্র- হেমন্তকে পাওয়া যায় টের
আমাদের চোখে মুখে কর্নিস’এ গিয়ে ধোঁয়া থামে
মাকড়ের জাল, ফালি, হলুদ কাগজ চারি-দিকে
অমর সূচনা সব নষ্ট হয়ে যায় পরিণামে
তম্বুরা, পুরাতন সোফা, বই বিক্রি হয়ে যায় সব
কলের-জলের মতো দামে
দেওদার-কাঠ দিয়ে সৃষ্টি করা জানালার পিছে
অসংখ্য খোলার ঘর থেকে হাসি বেজে ওঠে নিচে
সন্ধ্যার কিছু আগে শেষ সন্দিহান চিল কিছু ক্ষণ ব’সে থেকে গম্বুজের শিকে
‘সকলেরই তরে এক নরক প্রস্তুত’ ব’লে তাহাদের হাসি আর মহিলার কানকাটা প্রতিহাসিটিকে
নিয়ে উড়ে চ’লে যায় হামাগুড়ি দিয়ে-
দেয়ালে আরশিতে আমি চেয়ে দেখি নারীটির চোখ কোনও দিকে
বিষয়ে নিবিষ্ট হয়ে নেই
মসৃণ কাঠের ‘পরে রঁ্যাদার মতন নিজে মসৃণ হবে না কিছুতেই।

আমি তবে এইখানে ব’সে থাকি সমস্ত নকল দাঁত এঁটে নিয়ে মাড়ির উপরে
পৃথিবীর আহ্নিক গতির সুরে শৃঙ্খলার শব্দ শুনে
নিট হয়ে কনুইয়ের ভরে
ডোরাকাটা জেব্রা’র মতো সব অভিনব সূর্যালোক মহিলার শরীরের ‘পরে
অস্তের আকাশ থেকে এসে
তাকে দিয়ে বলাতেছে কথা:
‘এর পর নিজেকেই বিক্রি ক’রে দিতেছে লেজার
চারি-দিকে খোলার খোঁড়ল-ভরা বজেটের হাড়
কুকুরের চেয়ে বেশি মানুষের- মানুষের প্রতি অবিচার’
ব’লে যায় শীর্ণ তিতিরের মতো কেশে
যেন মৃত্যু ধ’রে নিয়ে গেছে তাকে সুদূর বিদেশে
ব্যভিচার করেছিল নারী সেইখানে গিয়ে- তবু সেই ছোঁড়া
ম’রে গেছে ঢের দিন- পটভূমি নানা-নানা আলো নিয়ে শূন্য, আনকোরা।
এ-রকম উপমায় আমাদের দু’ জনার মিল চির-দিন-
পাঁচ ফুট দূরে থেকে মুখোমুখি ঘোরা
সদ্য ব’সে থেকে তবু মনে হয় ঢের আগেকার কথা সব।
অগস্ত্য কি যাযাবর সে-সময়ে, মারীচ, অঙ্গিরস, পুলকেশী বিচারক প্রায়ান্ধ প্রতাপে
চির-দিন সেই সব নামে সব পৃথিবীর জনপদ কাঁপে
যা হয়েছে- যা হতেছে- হবে চির-দিন-
এখন একাকী ব’সে জোড়াতালি দিয়ে আমি করি সমাবেশ
হেমন্তের এ-রকম অস্পষ্ট নির্দেশ।