হংসেশ্বর চৌধুরি

– বহু দিন হংসেশ্বর চৌধুরি’র কোনও কথা শুনি না তো
শেষ বার তার সাথে দেখা হয়েছিল- দূর পূর্ব-বাংলার
কোনও এক মৌসুমির নদীর কিনারে
মনে হল দু’-শো বছরের যেন তিত্তিরাজগাছ-
কয়েকটা শকুনের বোঝা নিয়ে দাঁড়ায়ে রয়েছে
শকুনেরা বনস্পতিটির জানালায় ব’সে থেকে
তবুও শকুন নয় যেন আর- কঠিন নীলিমা থেকে নেমে এসে যেন
স্ফটিকের মতো কঠোর জিজ্ঞাসা নিয়ে ব’সে আছে
যেন এক স্থির- পৃথিবীর প্রথম আয়ুর আলো
আজ এই শতাব্দীর মুখে এসে তবু অন্ধকার হয় না ক’

– শকুনের বোঝা?
আষাঢ়ের নির্মেঘ এ-রাতে তিত্তিরাজগাছে।

– বেঁচে আছে?

– নেই; ম’রে গেছে ঢের দিন- তেরো-শো পঁচিশ সালে
তাহার পৃথুল নাভি কিছুতেই পুড়িল না; অনেক গভীর ঘৃত চন্দনের ঘ্রাণে
সেই আশি বছরের বুড়ো শ্মশানকে সারা-দিন তুষ্ট রেখেছিল
মরণকে মনে হয়েছিল: কোনও এক সিঁড়ি যেন মিনারের
দেবদারু-কাঠের উদ্রেকে- প্রভূত ব্যসনে যেন এঁকেবেঁকে
বিকেলবেলার অমোঘ পশ্চিমে যেন
আপনার আবেগের জিঘাংসায় জেগে উঠে চ’লে গেছে
দু’-চারটে আস্তাবলের ঘোড়া তবুও শ্মশানে থাকে চির-দিন
তারা বলে চৌধুরি’র নাভি চার পায়ে হেঁটে কাঁকড়া’র গর্তে ঢুকে গেছে
দু’-শো বছরের এক অশ্বত্থা’কে নদীর ও-পার থেকে
নতুন উদ্দমে জ্বেলে- একেবারে এ-পারের বাতাসে এনেছে
কিংবা কেউ বলে বড়ো কালো ভাগাড়ের-পাখির মতন
সেই নাভি উড়ে গেছে করোমণ্ডলের দিকে
মান্দ্রাজের উপকূলে

– জানি আমি।
আমরা আকাশ ভালোবেসে
কুয়াশার মতো বই পড়ি: আনন্দলহরী, প্লেটো, পতঞ্জলি
আউটরাম-ঘাটে ব’সে জাহাজের ফানেলের ধোঁয়া দেখে
ওর চেয়ে ঢের বেশি দিকনির্ণয়ের দৃষ্টি পাওয়া যাবে
(এ-যুগের যে-কোনও তরুণ খুলিকে- চার্বাক নয় শুধু তারা,
তাহাদের অমোঘ বৈশিষ্ট্য ঐখানে- শুধােলেই টের পাওয়া যাবে)
হংসেশ্বর যত দিন বেঁচেছিল পৃথিবীর মৃত্তিকায়
পেট্রোলিয়মের খনি আরও যেন বেশি ছিল
ম’রে গিয়ে আরও যেন গাঢ়তর হয়ে গেছে সেই সব

– কিন্তু- তবু- ফ্যাক্টরি সে তৈরি করে নাই

– পঞ্চাশ বছর এগিয়ে জন্মাত যদি
তা হলেও তার চবুতরা খুঁজে সেই হাঁস কেউ পেত না-কি
গর্ভের ভিতর থেকে একটি সোনার ডিম বার ক’রে
যে রোজ ভোরের মুখ দেখে
নয়- নয়;- মৃত্তিকাকে ভালোবেসেছিল- অতিকায় মৃত এক গুঁড়ির মতন যেন
নদীর কিনারে (শুয়ে থেকে) হাটবাজারের কাঠুরিয়াদের হাতে গড়ায়ে-গড়ায়ে।
কিছু বই পড়েছিল- বিচার করেছে আরও ঢের বেশি
খাগের কলম ধ’রে কিছুই লেখে নি।

– জ্যৈষ্ঠের দুপুরে যেন লঘু বাতাসের আরশিতে
মুখোমুখি আপনার প্রতিচ্ছবি দেখিতে চেয়েছে
পাণ্ডুলিপি থেকে আপনার যেই ছায়া জাগে- তাহা নয়?

– তাহা নয়।
আমাদের শিল্পী-মনীষীরা বুদ্ধি আর শিরদাঁড়া নিয়ে রাজ্য গড়ে
তাহাদের বহুতর বোধ আছে- জানি আমি
তবু তারা জীবনের থেকে পলাতক
এই পৃথিবীর জল তাদের গেলাসে আর জল নয়
যদিও শপথ ক’রে বলে: ‘জল- ইতিহাস- সমাজ- মানব-‘
সর্ষেবীজের মতো তবুও আশ্চর্য এক ঘুণাক্ষরে চাপা প’ড়ে
রূপ হয়ে যায় সব।

– তবুও আমরা ভাবি- ভাবি না কি? সত্য নয়: এই রূপ যেন সব-চেয়ে নিচ্ছিদ্র আলোক?
চেতনার পুরোহিত?

– (মনে করি- মিছে মনে করি)
সেই পুরোহিত যেন আলো ঢেলে এ-যুগের সূক্ষ্ম বয়স্কার নাসিকাকে
শেষ বিচারের তৃপ্তি দিতে পারে; যেন মনে হয় সেগুনের কাঠের গুদাম
যেই সব মজুরেরা আর-এক বার ট্রামলাইন মেরামত হবে
কিংবা তুমি- আমি- আমাদের সন্ততিরা
যেই সব বলিরেখা নিয়ে কালো হয়ে গেল
যেই সব মেধা, রক্ত, অন্ধকার নিয়ে আজ জীবনের গুপ্তচর
শিল্পীর জলের গ্লাসে তারা এই মৃত্তিকার সমুদ্রের মতো।
চিলের পালক থেকে একটি কলম চুরি ক’রে এনেছি প্রভাতে
দুপুরে গম্ভীর চোখে চেয়ে দেখি চিল যেন
ঢের রুষ্ট শতাব্দীর গ্রামনগরীকে লাটিমের মতো ঘুরাতেছে
বৃহস্পতি-নক্ষত্রের দিকে উড়ে চ’লে যায় সন্ধ্যার আঁধারে
তবুও কলম নিয়ে- মোম জ্বেলে- আবার মোদের কক্ষে ঢুকি।
জীবনের নির্ঘাত রোমশ হাত হংসেশ্বর চৌধুরি’র ছিল
আমাদের নেই। কলম বাটালি ব্রাশ জলে ছুঁড়ে ফেললেও পাব না কিছুই সেই সব
আমরা প্রবীণ আলোচনা করি শুধু- আধাে-সৃষ্টি করি
জীবনের প্রথম পীবর হাত স’রে গেলে- তার ক্ষীণ প্রণিধান
ভীরু প্রতিধ্বনিময় বজ্র থেকে চুরি ক’রে।

– হংসেশ্বর চৌধুরি’র শ্মশানে দাহের দিন মনে পড়ে
তাহার পৃথুল নাভি… উঠে চ’লে গেছে

– দু’-চারটে আস্তাবলের ঘোড়া… কাঁকড়া’র গর্তে ঢুকে গেছে

– দু’-একটি অভিমানী জীব তবু… এ-পারের বাতাস এনেছে

– কিংবা কেউ বলে… মান্দ্রাজের উপকূলে।