যাত্রা

জানি না কোথাও শুভ বন্দর রয়েছে কিনা;
কোথাও প্রাণের কল্যাণ-সূর্যালোক আছে?
কোথাও এ অসময় সময়ের নদী পার হওয়া যায়?
পার হ’লে সাগর কি শান্তি আলো মুক্তির ভেতরে
যাত্রীকে আশ্বাস দেয়?
মানুষের ভঙ্গুর সাহস ভয় যাত্রা আর জীবনের মানে
স্থান পায়- স্থানে এসে পরিণতি পায়?
হয়তো-বা পেয়ে যায়; অথবা সকলই অন্ধকার।
মানুষ যাত্রা করে-
যাত্রার প্রথম ফল সাগরের পথে নিরাপদে চলা
বন্দরের দিকে নিরুদ্বেগে যেতে পারা
বন্দরের থেকে বন্দরের বাঁধা পথ ছেড়ে দিয়ে
সমুদ্রের বড়ো আবিষ্কারে নেমে পড়া;
হৃদয় অন্তিম ফল হিসেবে আনন্দ চায়
শান্তি চায় নীল মহাসাগরের ভোরের আলোয়
আর একবার তার তারার আলোয়।
মানুষ জাহাজে চ’ড়ে জীবনের সমুদ্রে ভিড়েছে;
সাগর চলেছে- সময় চলেছে- মানুষ চলেছে-
ক্যাবিনের ছ্যাঁদার ভেতরে ঢুকে একা
(সাগরের স্পন্দনে শরীর অসহায়
বমি করে- কাঠবমি হল যেন-
নাড়ি যেন ছেড়ে গেছে ব’লে মনে হয়।)
ডেকে পাইচারি করে একা। একা। একা।
বর্শার ফলার মতো আলো এসে পড়ে।
স্তব্ধ হয়ে কোনও এক বিন্দুর ভিতরে থেমে থাকা।
অনেকের সাথে পরিচয় হয়, হাসিগল্প চলে,
মন ব্যথা পায়, বোকার মতন লাগে, ভীষণ অবাক মানে;
শোকাবহ ক্লান্তি র’য়ে গেছে; ভয়াবহ বেদ আছে:
সূর্যের নক্ষত্রের জাহাজের বিদ্যুতের আলোর ভিতরে
কেউ-কেউ গুঞ্জরন উচ্চারণ করে যায়;
কেউ-কেউ অবচেতনায় চেপে রেখে দিতে চায় সব;
কারও-কারও মন স্বভাবত নিহতচেতন;
হাসছে খেলছে গুলগল্পে গরমে মেতে আছে-
খাচ্ছে- ছুটছে- চালানি মালের মতো দিনরাত দিচ্ছে নিচ্ছে
দেহ- ভালবাসা- (দেহমাংস)-
সারা দিন চামড়া মাংস বিকিকিনি শেষ হয়ে গেলে
তারার আলোয় এসে ঘ-মানুষের মতো এরাও মানুষ;
আচ্ছন্ন করুণ, চেতনা জেগেছে, পথ নেই, বিন্দুর ভিতরে
স্তব্ধ হয়ে রয়েছে জাহাজ- মুর্গির খাঁচার মতো যেন;
তবুও তা নয়-
আকাশ বিমুক্ত হয়ে আছে।
অনন্তে যে কথা আছে সব স্পর্শসহ
বেতারের বুকে এসে ধরা পড়ে;
জিজ্ঞাসার আলোড়ন- প্রশ্নের মীমাংসা- লেনদেন
কেবলই চলেছে সারা দিন।
জাহাজ চালায় যারা বুদ্ধিমান- নৌবিদ্যাপ্রবীণ
তবু বলে: জাহাজডুবির গল্পে সাগর ভরাট,
হাজার বছর ধ’রে কেবলই ডুবছে;
যাত্রীরা ম’রে গেছে- নতুন যাত্রীর দল তারপর,
নৌজ্ঞান এবারে গভীরতর হয়েছে যদিও
কেবলই বিপদ আছে বাঁকে- পথে- তবু
যাত্রীরা বিপন্ন চিরদিন-
ম’রে যেতে হবে- যাত্রী, তবু চলো-
না ডুবেও ডুবে যাওয়া যায় দু’টো সাগরের জলে-
না মরেও প্রতি মুহুর্তেই তবু ম’রে যেতে হয়;
জীবনের বিনিপাত প্রতি নিমেষেই আছে-
প্রতি নিমেষেই জীবন মরছে, যাত্রী, সাগরনির্জন তলাতলে
কোথায় ডুবছে চিন্তা অনুবেদনায় ভরপুর যাত্রীদের মাথা
বুদবুদের শূন্যে ভরপুর৷
মৃত মাথা আপনার জীবনের খবর রাখছে-
কত বার মৃত্যু হ’ল ভাবছে- গুনছে-
সাগরের তলে- আরও অন্ধকার তলে লীন হয়ে গিয়ে তবু
জাহাজের ডেকের ওপরে ফিরে আসা,
খাওয়া, হাসা, খেলা করা, কথা বলা, চিন্তা করা,
বন্ধু হওয়া, ভেক ধ’রে থাকা, পরামর্শ দেওয়া,
রেজিষ্ট্রির সময় হয়েছে ভেবে খাতায় স্বাক্ষর ক’রে বিয়ে করা
কাকে যেন: জীবনতো বিবাহিত হয়ে ছিল ঢের বার;
বারবার: বিচ্ছিন্ন হয়েছে বারবার
হয়তো এ জন্মের নয়- এই দিকে- এই প্রান্তে নয়-
চারি দিকে অন্ধকার বেড়ে ওঠে;
ঘুমোবার ভান ক’রে প’ড়ে আছে ঢের যাত্রী
ভান ঢের ভাল হ’লে অঘোরে ঘুমোবে;
কারো চোখে ঘুম নেই;
মৃত্যু হলে শব সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হয়-
সেই মৃত্যু নেই;
অন্য এক হেঁটে চলা ব’সে থাকা কথা শেষ-
কথা শেষ না করার মৃত্যু আছে।
এক জোড়া তাস নিয়ে জাদুকর হয়ে
খেলা করা যেত যদি এই অন্ধকারে,
জাহাজ ভর্তি সব পুরুষমেয়েকে যদি খানিক উড়ুক্কু ভোজবাজি
কি করে টুপির থেকে অনেক পায়রা বা’র করে
উচ্ছ্বাসে ওড়ানো যায়- দেখিয়ে ওড়ানো যেত হৃদয়কে
অনন্ত রাত্রির দিকে উন্মাদ উৎসবে-
জাহাজ ডুবির গল্পে সাগর ভরাট,
হাজার বছর ধ’রে কেবলই ডুবছে,
যাত্রীরা ম’রে গেছে- নতুন যাত্রীর দল তারপর,
নৌজ্ঞান এবারে গভীরতর হয়েছে যদিও
কেবলই বিপদ আছে বাঁকে- পথে- তবু
যাত্রীরা বিপন্ন চিরদিন-
ম’রে গিয়ে তবু
মৃত্যুশীল- মৃত্যুর নিঃশেষ নেই- নেই- যাত্রী চলছে।