জীবন

চারি-দিকে বেজে ওঠে অন্ধকার সমুদ্রের স্বর,-
নতুন রাত্রির সাথে পৃথিবীর বিবাহের গান!
ফসল উঠিছে ফ’লে- রসে-রসে ভরিছে শিকড়;
লক্ষ নক্ষত্রের সাথে কথা কয় পৃথিবীর প্রাণ!
সে কোন্ প্রথম ভোরে পৃথিবীতে ছিল যে সন্তান
অঙ্কুরের মতো আজ জেগেছে সে জীবনের বেগে!
আমার দেহের গন্ধে পাই তার শরীরের ঘ্রাণ,-
সিন্ধুর ফেনার গন্ধ আমার শরীরে আছে লেগে!
পৃথিবী রয়েছে জেগে চক্ষু মেলে,- তার সাথে সে-ও আছে জেগে!


নক্ষত্রের আলো জ্বেলে পরিষ্কার আকাশের ‘পর
কখন এসেছে রাত্রি!- পশ্চিমের সাগরের জলে
তার শব্দ;- উত্তর সমুদ্র তার,- দক্ষিন সাগর
তাহার পায়ের শব্দে- তাহার পায়ের কোলাহলে
ভ’রে ওঠে;- এসেছে সে আকাশের নক্ষত্রের তলে
প্রথম যে এসেছিল, তারই মতো;- তাহার মতন
চোখ তার,- তাহার মতন চুল,- বুকের আঁচলে
প্রথম মেয়ের মতো;- পৃথিবীর নদী-মাঠ-বন
আবার পেয়েছে তারে,- সমুদ্রের পারে রাত্রি এসেছে এখন!


সে এসেছে,- আকাশের শেষ আলো পশ্চিমের মেঘে
সন্ধ্যার গহ্বর খুঁজে পালায়েছে!- রক্তে-রক্তে লাল
হয়ে গেছে বুক তার,- আহত চিতার মতো বেগে
পালায়ে গিয়েছে রোদ,- স’রে গেছে আলোর বৈকাল!
চ’লে গেছে জীবনের ‘আজ’ এক,- আর এক ‘কাল’;
আসিত না যদি আর আলো লয়ে- রৌদ্র সঙ্গে লয়ে!
এই রাত্রি- নক্ষত্র সমুদ্র লয়ে এমন বিশাল
আকাশের বুক থেকে পড়িত না যদি আর ক্ষ’য়ে-
র’য়ে যেত,- যে গান শুনি নি আর তাহার স্মৃতির মতো হয়ে!


যে পাতা সবুজ ছিল,- তবুও হলুদ হতে হয়,-
শীতের হাড়ের হাত আজও তারে যায় নাই ছুঁয়ে-
যে মুখ যুবার ছিল, তবু যার হয়ে যায় ক্ষয়,
হেমন্ত রাতের আগে ঝ’রে যায়,- প’ড়ে যায় নুয়ে;-
পৃথিবীর এই ব্যথা বিহ্বলতা অন্ধকারে ধুয়ে
পূর্ব সাগরের ঢেউয়ে,- জলে-জলে, পশ্চিম সাগরে
তোমার বিনুনি খুলে,- হেঁট হয়ে,- পা তোমার থুয়ে,-
তোমার নক্ষত্র জ্বেলে- তোমার জলের স্বরে-স্বরে
র’য়ে যেতে যদি তুমি আকাশের নীচে- নীল পৃথিবীর ‘পরে!


ভোরের সূর্যের আলো পৃথিবীর গুহায় যেমন
মেঘের মতন চুল- অন্ধকার চোখের আস্বাদ
একবার পেতে চায়;- যে জন রয় না- যেই জন
চ’লে যায়, তারে পেতে আমাদের বুকে যেই সাধ-
যে ভালোবেসেছে শুধু, হয়ে গেছে হৃদয় অবাধ
বাতাসের মতো যার,- তাহার বুকের গান শুনে
মনে যেই ইচ্ছা জাগে;- কোনোদিন দেখে নাই চাঁদ
যেই রাত্রি,- নেমে আসে লক্ষ-লক্ষ নক্ষত্রেরে গুনে
যেই রাত্রি, আমি তার চোখে চোখ, চুলে তার চুল নেব বুনে!


তুমি র’য়ে যাবে,- তবু,- অপেক্ষায় রয় না সময়
কোনোদিন;- কোনোদিন রবে না সে পথ থেকে স’রে!
সকলেই পথ চলে,- সকলেই ক্লান্ত তবু হয়;-
তবুও দু’জন কই ব’সে থাকে হাতে হাত ধ’রে!
তবুও দু’জন কই কে কাহারে রাখে কোলে ক’রে!
মুখে রক্ত ওঠে- তবু কমে কই বুকের সাহাস!
যেতে হবে,- কে এসে চুলের ঝুঁটি টেনে লয় জোরে!
শরীরের আগে কবে ঝ’রে যায় হৃদয়ের রস!-
তবু,- চলে,- মৃত্যুর ঠোঁটের মতো দেহ যার হয় নি অবশ!


হলদে পাতার মতো আমাদের পথে ওড়াউড়ি!-
কবরের থেকে শুধু আকাঙ্ক্ষার ভূত লয়ে খেলা!-
আমরাও ছায়া হয়ে, ভূত হয়ে করি ঘোরাঘুরি!
-মনের নদীর পার নেমে আসে তাই সন্ধ্যাবেলা
সন্ধ্যার অনেক আগে!- দুপুরেই হয়েছি একেলা!
আমরাও চরি-ফিরি কবরের ভূতের মতন!
বিকাল বেলার আগে ভেঙে গেছে বিকালের মেলা-
শরীর রয়েছে, তবু ম’রে গেছে আমাদের মন!
হেমন্ত আসে নি মাঠে,- হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন!


শীত রাত ঢের দূরে,- অস্থি তবু কেঁপে ওঠে শীতে!
সাদা হাত দু’টো সাদা হাড় হয়ে মৃত্যুর খবর
একবার মনে আনে,- চোখ বুজে তবু কি ভুলিতে
পারি এই দিনগুলো!- আমাদের রক্তের ভিতর
বরফের মতো শীত,- আগুনের মতো তবু জ্বর!
যেই গতি,- সেই শক্তি পৃথিবীর অন্তরে পঞ্জরে;-
সবুজ ফলায়ে যায় পৃথিবীর বুকের উপর,-
তেমনি স্ফুলিঙ্গ এক আমাদের বুকে কাজ করে!
শস্যের কীটের আগে আমাদের হৃদয়ের শস্য তবু মরে!


যতদিন র’য়ে যাই এই শক্তি র’য়ে যায় সাথে-
বিকালের দিকে যেই ঝড় আসে তাহার মতন!
যে ফসল নষ্ট হবে তারই খেত উড়াতে ফুরাতে
আমাদের বুকে এসে এই শক্তি করে আয়োজন!
নতুন বীজের গন্ধে ভ’রে দেয় আমাদের মন
এই শক্তি,- একদিন হয়েতো বা ফলিবে ফসল!-
এরই জোরে একদিন হয়তো বা হৃদয়ের বন
আহ্লাদে ফেলিবে ভ’রে অলক্ষিত আকাশের তল!
দুরন্ত চিতার মতো গতি তার,- বিদ্যুতের মতো সে চঞ্চল!

১০
অঙ্গারের মতো তেজ কাজ করে অন্তরের তলে,-
যখন আকাঙ্ক্ষা এক বাতাসের মতো বয়ে আসে,
এই শক্তি আগুনের মতো তার জিভ তুলে জ্বলে!
ভস্মের মতন তাই হয়ে যায় হৃদয় ফ্যাকাশে!
জীবন ধোঁয়ার মতো,- জীবন ছায়র মতো ভাসে;
যে অঙ্গার জ্ব’লে-জ্ব’লে নিভে যাবে,- হয়ে যাবে ছাই,
সাপের মতন বিষ লয়ে সেই আগুনের ফাঁসে
জীবন পুড়িয়া যায়;- আমরাও ঝ’রে পুড়ে যাই!
আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলিবার মতো শক্তি- তবু শক্তি চাই!

১১
জানো তুমি?- শিখেছ কি আমাদের ব্যর্থতার কথা?
হে ক্ষমতা, বুকে তুমি কাজ কর তোমার মতন-
তুমি আছ,- রবে তুমি,- এর বেশী কোনো নিশ্চয়তা
তুমি এসে দিয়েছ কি?- ওগো মন, মানুষের মন-
হে ক্ষমতা,- বিদ্যুতের মতো তুমি সুন্দর-ভীষণ!
মেঘের ঘোড়ার ‘পরে আকাশের শিকারীর মতো;-
সিন্ধুর সাপের মতো লক্ষ ঢেউয়ে তোল আলোড়ন!
চমৎকৃত কর,- শরীরেরে তুমি করেছ আহত!-
যতই জেগেছ,- দেহ আমাদের ছিঁড়ে যেতে চেয়েছে যে তত!

১২
তবু তুমি শীত রাতে আড়ষ্ট সাপের মতো শুয়ে
হৃদয়ের অন্ধকারে পড়ে থাক,- কুণ্ডলী পাকায়ে!-
অপেক্ষায় ব’সে থাকি,- স্ফুলিঙ্গের মতো যাবে ছুঁয়ে
কে তোমারে!- ব্যাধের পায়ের পাড়া দিয়ে যাবে গায়ে
কে তোমার!- কোন্ অশ্রু, কোন্ পীড়া হতাশার ঘায়ে
কখন জাগিয়া ওঠো- স্থির হয়ে ব’সে আছি তাই।
শীত-রাত বাড়ে আরো,- নক্ষত্রেরা যেতেছে হারায়ে,-
ছাইয়ে যে আগুন ছিল সেই সবও হয়ে যায় ছাই!
তবুও আরেকবার সব ভস্মে অন্তরের আগুন ধরাই।

১৩
অশান্ত হাওয়ার বুকে তবু আমি বনের মতন
জীবনেরে ছেড়ে দিছি!- পাতা আর পল্লবের মতো
জীবন উঠেছে বেজে শব্দে- স্বরে; যতবার মন
ছিঁড়ে গেছে,- হয়েছে দেহের মতো হৃদয় আহত
যতবার;- উড়ে গেছে শাখা, পাতা প’ড়ে গেছে যত;-
পৃথিবীর বন হয়ে- ঝড়ের গতির মতো হয়ে,
বিদ্যুতের মতো হয়ে আকাশের মেঘে ইতস্তত;
একবার মৃত্যু লয়ে- একবার জীবনেরে লয়ে
ঘূর্ণির মতন বয়ে যে বাতাস ছেঁড়ে,- তার মতো গেছি বয়ে!

১৪
কোথায় রয়েছে আলো-আঁধারের বীণার আস্বাদ!
ছিন্ন রুগ্ন ঘুমন্তের চোখে এক সুস্থ স্বপ্ন হয়ে
জীবন দিয়েছে দেখা;- আকাশের মতন অবাধ
পরিচ্ছন্ন পৃথিবীতে, সিন্ধুর হাওয়ার মতো বয়ে
জীবন দিয়েছে দেখা;- জেগে উঠে সেই ইচ্ছা লয়ে
আড়ষ্ট তারার মতো চমকায়ে গেছি শীতে-মেঘে!
ঘুমায়ে যা দেখি নাই, জেগে উঠে তার ব্যথা সয়ে
নির্জন হতেছে ঢেউ হৃদয়ের রক্তের আবেগে!
-যে আলো নিভিয়া গেছে তাহার ধোঁয়ার মতো প্রাণ আছে জেগে।

১৫
নক্ষত্র জেনেছে কবে অই অর্থ শৃঙ্খলার ভাষা!
বীণার তারের মতো উঠিতেছে বাজিয়া আকাশে
তাদের গতির ছন্দ,- অবিরত শক্তির পিপাসা
তাহাদের,- তবু সব তৃপ্ত হয়ে পূর্ণ হয়ে আসে!
আমাদের কাজ চলে ইশারায়,- আভাসে-আভাসে!
আরম্ভ হয় না কিছু- সমস্তের তবু শেষ হয়,-
কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে
তারও বড় ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়!
যা হয়েছে শেষ হয়,- শেষ হয় কোনোদিন যা হবার নয়!

১৬
সমস্ত পৃথিবী ভ’রে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস
দোলা দিয়ে গেল কবে!- বাসি পাতা ভূতের মতন
উড়ে আসে!- কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস,-
যক্ষ্মার রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন!-
জীবনের চেয়ে সুস্থ মানুষের নিভৃত মরণ!
মরণ,- সে ভালো এই অন্ধকার সমুদ্রের পাশে!
বাঁচিয়া থাকিতে যারা হিঁচড়ায়- করে প্রাণপণ,-
এই নক্ষত্রের তলে একবার তারা যদি আসে,-
রাত্রিরে দেখিয়া যায় একবার সমুদ্রের পারের আকাশে!-

১৭
মৃত্যুরেও তবে তারা হয়তো ফেলিবে বেসে ভালো!
সব সাধ জেনেছে যে সেও চায় এই নিশ্চয়তা!
সকল মাটির গন্ধ আর সব নক্ষত্রের আলো
যে পেয়েছে,- সকল মানুষ আর দেবতার কথা
যে জেনেছে,- আর এক ক্ষুধা তবু- এক বিহ্বলতা
তাহারও জানিতে হয়! এইমতো অন্ধকারে এসে!-
জেগে-জেগে যা জেনেছ,- জেনেছ তা- জেগে জেনেছ তা,-
নতুন জানিবে কিছু হয়তো বা ঘুমের চোখে সে!
সব ভালোবাসা যার বোঝা হ’ল,- দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে!

১৮
কিম্বা এই জীবনেরে একবার ভালোবেসে দেখি!-
পৃথিবীর পথে নয়,- এইখানে- এইখানে ব’সে-
মানুষ চেয়েছে কিবা? পেয়েছে কি?- কিছু পেয়েছে কি!
হয়তো পায় নি কিছু,- যা পেয়েছে, তাও গেছে খ’সে
অবহেলা ক’রে-ক’রে কিম্বা তার নক্ষত্রের দোষে;-
ধ্যানের সময় আসে তারপর,- স্বপ্নের সময়!
শরীর ছিঁড়িয়া গেছে,- হৃদয় পড়িয়া গেছে ধ’সে!-
অন্ধকার কথা কয়,- আকাশের তারা কথা কয়
তারপর,- সব গতি থেমে যায়,- মুছে যায় শক্তির বিস্ময়!

১৯
কেউ আর ডাকিবে না,- এইখানে এই নিশ্চয়তা!-
তোমার দু-চোখ কেউ দেখে থাকে যদি পৃথিবীতে,
কেউ যদি শুনে থাকে কবে তুমি কী কয়েছ কথা,
তোমার সহিত কেউ থেকে থাকে যদি সেই শীতে,-
সেই পৃথিবীর শীতে,- আসিবে কি তোমারে চিনিতে
এইখানে সে আবার!- উঠানে পাতার ভিড়ে ব’সে,
কিম্বা ঘরে- হয়তো দেয়ালে আলো জ্বেলে দিতে-দিতে,-
যখন হঠাৎ নিভে যাবে তার হাতের আলো সে,-
অসুস্থ পাতার মতো দুলে তার মন থেকে প’ড়ে যাব খ’সে!

২০
কিম্বা কেউ কোনোদিন দেখে নাই,- চেনে নি আমারে!
সকাল বেলার আলো ছিল যার সন্ধ্যার মতন,-
চকিত ভূতের মতো নদী আর পাহাড়ের ধারে
ইশারায় ভূত ডেকে জীবনের সব আয়োজন
আরম্ভ সে করেছিল!- কোনোদিন কোনো লোকজন
তার কাছে আসে নাই;- আকাঙ্ক্ষার কবরের ‘পরে
পুবের হাওয়ার মতো এসেছে সে হঠাৎ কখন!-
বীজ বুনে গেছে চাষা,- সে বাতাস বীজ নষ্ট করে!
ঘুমের চোখের ‘পরে নেমে আসে অশ্রু আর অনিদ্রার স্বরে!

২১
যেমন বৃষ্টির পরে ছেঁড়া-ছেঁড়া কালো মেঘ এসে
আবার আকাশ ঢাকে,- মাঠে-মাঠে অধীর বাতাস
ফোঁপায় শিশুর মতো,- একবার চাঁদ ওঠে ভেসে,-
দূরে- কাছে দেখা যায় পৃথিবীর ধান খেত ঘাস,
আবার সন্ধ্যার রঙে ভ’রে ওঠে সকল আকাশ,-
মড়ার চোখের রঙে সকল পৃথিবী থাকে ভ’রে!-
যে ম’রে যেতেছে তার হৃদয়ের সব শেষ শ্বাস
সকল আকাশ আর পৃথিবীর থেকে পড়ে ঝ’রে!-
জীবনে চলেছি আমি সে পৃথিবী আকাশের পথ ধ’রে-ধ’রে!

২২
রাত্রির ফুলের মতো- ঘুমন্তে হৃদয়ের মতো
অন্তর ঘুমায়ে গেছে,- ঘুমায়েছে মৃত্যুর মতন!-
সারা-দিন বুকে ক্ষুধা লয়ে চিতা হয়েছে আহত,-
তারপর,- অন্ধকার গুহা এই- ছায়াভরা বন
পেয়েছে সে!- অশান্ত হাওয়ার মতো মানুষের মন
বুজে গেছে- রাত্রি আর নক্ষত্রের মাঝখানে এসে!-
মুত্যুর শান্তির স্বাদ এইখানে দিতেছে জীবন,-
জীবনেরে এইখানে একবার দেখি ভালোবেসে!
শুনে দেখি,- কোন্ কথা কয় রাত্রি, কোন্ কথা নক্ষত্র বলে সে!

২৩
পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভ’রে-
শস্য ফ’লে গেছে মাঠে,- কেটে নিয়ে চ’লে গেছে চাষা;
নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ করে
নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা,-
মৃত্যুর মতন তার জীবনের বেদনার ভাষা,-
আবার জানায়ে যায়!- কবরের ভূতের মতন
পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা-হতাশা,-
বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন!
মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন!

২৪
হলুদ পাতার মতো,- আলোয়ার বাষ্পের মতন,
ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেঁড়া-মেঘ আকাশের ধারে,
আলোর মাছির মতো- রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন
একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে,-
ঢেউ ভেঙে ঝ’রে যায়,- ম’রে যায়,- কে ফেরাতে পারে!
তবুও ইশারা করে ফাল্গুন-রাতের গন্ধে বয়ে
মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আঁধারে
জীবন ডাকিতে আসে;- হয় নাই- গিয়েছে যা হয়ে,
মৃত্যুরেও ডাক তুমি সেই ব্যথা-আকাঙ্ক্ষার অস্থিরতা লয়ে!

২৫
মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো,- প্রিয়ার মতন!
চকিত শিশুর মতো তার কোলে লুকায়েছি মুখ;
রোগীর জ্বরের মতো পৃথিবীর পথের জীবন;
অসুস্থ চোখের ‘পরে অনিদ্রার মতন অসুখ;
তাই আমি প্রিয়তম;- প্রিয়া বলে জড়ায়েছি বুক,-
ছায়ার মতন আমি হয়েছি তোমার পাশে গিয়া!-
যে-ধূপ নিভিয়া যায় তার ধোঁয়া আঁধারে মিশুক,-
যে ধোঁয়া মিলায়ে যায় তারে তুমি বুকে তুলে নিয়া
ঘুমানো গন্ধের মতো স্বপ্ন হয়ে তার ঠোঁটে চুমো দিয়ো, প্রিয়া!

২৬
মৃত্যুকে ডেকেছি আমি প্রিয়ের অনেক নাম ধ’রে।
যে বালক কোনোদিন জানে নাই গহ্বরের ভয়,
পুবের হাওয়ার মতো ভূত হয়ে মন তার ঘোরে!-
নদীর ধারে সে ভূত একদিন দেখেছে নিশ্চয়!
পায়ের তলের পাতা- পাপড়ির মতো মনে হয়
জীবনেরে,- খ’সে ক্ষ’য়ে গিয়েছে যে, তাহার মতন
জীবন পড়িয়া থাকে- তার বিছানায় খেদ,- ক্ষয়-
পাহাড় নদীর পারে হাওয়া হয়ে ভূত হয়ে মন
চকিত পাতার শব্দে বাতাসের বুকে তারে করে অন্বেষণ।

২৭
জীবন,- আমার চোখে মুখ তুমি দেখেছ তোমার,-
একটি পাতার মতো অন্ধকারে পাতা-ঝরা গাছে;-
একটি বোঁটার মতো যে ফুল ঝরিয়া গেছে তার;-
একাকী তারার মতো, সব তারা আকাশের কাছে
যখন মুছিয়া গেছে,- পৃথিবীতে আলো আসিয়াছে;-
যে ভালোবেসেছে, তার হৃদয়ের ব্যথার মতন;-
কাল যাহা থাকিবে না,- আজই যাহা স্মৃতি হয়ে আছে;-
দিন-রাত্রি- আমাদের পৃথিবীর জীবন তেমন!
সন্ধ্যার মেঘের মতো মুহুর্তের রঙ লয়ে মুহূর্তে নূতন!

২৮
আশঙ্কা ইচ্ছার পিছে বিদ্যুতের মতো কেঁপে ওঠে!
বীণার তারের মতো কেঁপে-কেঁপে ছিঁড়ে যায় প্রাণ!
অসংখ্যা পাতার মতো লুটে তারা পথে-পথে ছোটে,-
যখন ঝড়ের মতো জীবনের এসেছে আহ্বান!
অধীর ঢেউয়ের মতো- অশান্ত হাওয়ার মতো গান
কোনদিকে ভেসে যায়!- উড়ে যায়,- কয় কোন্ কথা!-
ভোরের আলোয় আজ শিশিরের বুকে যেই ঘ্রাণ,
রহিবে না কাল তার কোনো স্বাদ- কোনো নিশ্চয়তা!
পাণ্ডুর পাতার রঙ গালে,- তবু রক্তে তার রবে অসুস্থতা!

২৯
যেখানে আসে নি চাষা কোনোদিন কাস্তে হাতে লয়ে,
জীবনের বীজ কেউ বোনে নাই যেইখানে এসে,
নিরাশার মতো ফেঁপে চোখ বুজে পলাতক হয়ে
প্রেমের মৃত্যুর চোখে সেইখানে দেখিয়াছি শেষে!
তোমার চোখের ‘পরে তাহার মুখেরে ভালোবেসে
এখানে এসেছি আমি,- আর একবার কেঁপে উঠে
অনেক ইচ্ছার বেগে,- শান্তির মতন অবশেষে
সব ঢেউ ভেঙে নিয়ে ফেনার ফুলের মতো ফুটে,
ঘুমাব বালির ‘পরে;- জীবনের দিকে আর যাব নাকো ছুটে!

৩০
নির্জন রাত্রির মতো শিশিরের গুহার ভিতরে,-
পৃথিবীর ভিতরের গহ্বরের মতন নিঃসাড়
রব আমি;- অনেক গতির পর- আকাঙ্ক্ষার পরে
যেমন থামিতে হয়, বুজে যেতে হয় একবার-
পৃথিবীর পারে থেকে কবরের মৃত্যুর ওপার
যেমন নিস্তব্ধ শান্ত নিমীলিত শূন্য মনে হয়-
তেমন আস্বাদ এক কিম্বা সেই স্বাদহীনতার
সাথে একবার হবে মুখোমুখি সব পরিচয়!
শীতের নদীর বুকের মৃত জোনাকির মুখ তবু সব নয়!

৩১
আবার পিপাসা সব ভূত হয়ে পৃথিবীর মাঠে,-
অথবা গ্রহের ‘পরে- ছায়া হয়ে, ভূত হয়ে ভাসে!-
যেমন শীতের রাতে দেখা যায় জ্যোৎস্না ধোঁয়াটে,
ফ্যাকাশে পাতার ‘পরে দাঁড়ায়েছে উঠানের ঘাসে;-
যেমন হঠাৎ দু’টো কালো পাখা চাঁদের আকাশে
অনেক গভীর রাতে চমকের মতো মনে হয়;
কার পাখা?- কোন্ পাখি? পাখি সে কি! অথচ সে আসে!-
তখন অনেক রাতে কবরের মুখ কথা কয়!-
ঘুমন্ত তখন ঘুমে, জাগিতে হতেছে যার সে জাগিয়া রয়!

৩২
বনের পাতার মতো কুয়াশায় হলুদ না হতে,
হেমন্ত আসার আগে হিম হয়ে পড়ে গেছি ঝরে!-
তোমার বুকের ‘পরে মুখ আমি চেয়েছি লুকোতে;
তোমার দুইটি চোখ প্রিয়ার চোখের মতো ক’রে
দেখিতে চেয়েছি, মৃত্যু, পথ থেকে ঢের দূরে সরে
প্রেমের মতন হয়ে!- তুমি হবে শান্তির মতন!-
তারপর সরে যাব- তারপর তুমি যাবে মরে-
অধীর বাতাস লয়ে কাঁপুক না পৃথিবীর বন!-
মৃত্যুর মতন তবু বুজে যাক- ঘুমাক মৃত্যুর মতো মন!

৩৩
নির্জন পাতার মতো, আলেয়ার বাষ্পের মতন,
ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেঁড়া মেঘে আকাশের ধারে,
আলোর মাছির মতো- রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন
একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে-
ঢেউ ভেঙে ঝরে যায়- মোরে যায়,- কে ফেরাতে পারে!
তবুও ইশারা ক’রে ফাল্গুনরাতের গন্ধে বয়ে
মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আাঁধারে
জীবন ডাকিতে আসে- হয় নাই- গিয়েছে যা হয়ে-
মৃত্যুরেও ডাক তুমি সেই স্মৃতি-আকাঙ্ক্ষার অস্থিরতা লয়ে!

৩৪
পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভ’রে-
শস্য ফলে গেছে মাঠে- কেটে নিয়ে চলে গেছে চাষা;
নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ করে
নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা-
মৃত্যুর মতন তার জীবনের বেদনার ভাষা-
আবার জানায়ে যায়- কবরের ভূতের মতন
পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা-হতাশা-
বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন!-
মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন!