জীয়নকাঠি

কাহারও জীয়নকাঠি গায়ে লাগে এসে
সকলই চেতনা যেন হয়
বড়ো-বড়ো হৌস থেকে নেমে আসে ওরা
কাজ সাঙ্গ ক’রে রেখে বিকেলবেলায়

প্রাকপুরাণিক সব ধুলোমাখা বাড়ি
হুগলি নদীর পাড় জুড়ে
সন্দিগ্ধ সূর্যের থেকে- আবডালে স’রে
প্রাচীন ঘড়ির সাথে ঘুরে

এরা সব ঘুরে গেছে সারা-দিন
জিনের কোটের ‘পরে তার পর বিকেলের রোদ
অথবা নানান কোট নানান রঙের
একটি নির্জন অর্থবোধ

আর সব অন্য এক ভূশণ্ডির কর্নিসের থেকে
উঠে আসে চোখের গোলকে গোল ধাঁধার মতন
সারা-দিন মানে খুঁজে- সন্ধ্যার লগ্ন এসে গেলে
কিছুই হয় না চতুষ্কোণ

কিংবা দু’টো চালু রেখা- সমস্ত জীবন
সমান্তরাল ভাবে চ’লে।
ডকের কুলিরা তবু জাহাজের গুণ হয়ে যেত
ক্লাইভ স্ট্রিট কালি আর বংশাল হ’লে।

চোখ বুজে ব’য়ে নেয়- নিত যদি বৈকুণ্ঠের দিকে
চোখ বুঝে ব’য়ে নেয়- নিত যদি নরকের পানে
নিসর্গ তবুও প্রতি নিজের জিনিস
চিনে নেয় আনুপূর্বিক অভিজ্ঞানে।

এরাও বৃক্ষের মতো- জীবাণুর মতো
সরীসৃপ- পাখি- ব্যাং- নক্ষত্রের মতো
নিসর্গের নিজের নিয়ম থেকে জেগে উঠে ধীরে
তার পরে শৃঙ্খলায়- পরিতাপে- মর্যাদাবশত

চারু চর্চা ক’রে গেছে জীবনকে নিয়ে
প্রকৃতিও পেয়েছিল সে-সব আস্বাদ
তবুও প্রকৃতি নয়- হয়তো-বা প্রকৃতি নিজেই
নিতান্ত নিজের জ্ঞানে সেধেছিল বাদ

ভেবেছিল: ‘ও-রকম লেজুড় কি র’বে- ক্ষ’য়ে গেছে?
যখন মানুষ ঢের কল্প আগে হয়েছিল লাঙ্গুলবিহীন
প্রকৃতির এ-রকম অনুভাব তবুও তো অর্থহীন নয়
আমাদের মীমাংসার ভাষা (তবে- সে কি) অর্থহীন?’

ভেবেছিল: ‘ও-রকম লেজুড় কি র’বে? ক্ষ’য়ে গেছে?-
সূর্য নদী আকাশ মেঘের থেকে ন’ড়ে
অনেক কল্প ধ’রে মানুষকে গ’ড়ে গেছি আমি’
‘আমরাও সমাজকে গেছি ভেঙে-গ’ড়ে’

এই প্রত্যুত্তর তাকে জনরবে, নীরবে পাঠাই
বিকেলের এক মুঠো ঘাসের ভিতরে
যদি তাহা ভেদ করে- নিসর্গকে ডেকে নিতে পারি;-
তবু সে শোনে নি ব’লে প্রত্যাখ্যান করে?

ব’লে যায়: ‘ও-রকম লেজুড় কি র’বে? ক্ষয়ে গেছে?’
যদিও আমরা ভাবি ওর কোনও চোখ নেই বটে
শত্রুবাদী, সাম্যবাদী, ভারসাম্যবাদী
মিথ্যাবাদী, আধো-সত্যবাদী সব মানুষের মুখের নিকটে

তবুও হলুদ চোখ দু’টো স্থির ক’রে সারা-রাত
সারা-দিন চেয়ে আছে- আমাদের মুখের উপরে
হ্যালিটোসিসের মতো- মাঝে-মাঝে মনে হয়- যেন তার ঘ্রাণ
অথবা নদীর মতো যেন তার সচকিত অভিজ্ঞান নড়ে।

(সহসা সূর্যের আলো ক্ষীণ হয়ে যায়
চেয়ে দেখি দীর্ঘ চঙ্গ বেয়ে যেন করে ওঠানামা
সূর্য যেন- অন্য কোনও সূর্য এল ব’লে
কান পেতে সে-ও শোনে- শোনা যায় আলোর তর্জমা

জল, আলো, বাতাসকে উল্লঙ্ঘন ক’রে
প্রান্তরের ‘পরে ফেলে রেখে দিল শরতের ঘাস
তথাপি দেখেছি ভিন্ন তৃণ, সূর্য, অপর হরিণ
যখনই জেগেছে চোখে চোখের দেখায় অবিশ্বাস।)

কিংবা সব উঁচু-উঁচু বৃক্ষের শিকড়
অথবা সবুজ ফিকে গুল্মের বামন
কেবল সে-মানুষের পৃথিবীতে বিদূষক নেই জেনে বেঁকে
আমাদের হৃদয়ের প্রসাদকে করে বিদূষণ।

‘আমরাও’, এই সব ইশারাকে ডেকে বলি, ‘সমাজকে গেছি ভেঙে-গ’ড়ে’
তার পর এ-রকম নর চাই- নারী চাই- ভালোবাসাবাদ
কোনও এক দিন চাই সকলের তরে সূর্যে জেগে
এ-রকম ঘর বাড়ি চিত্ত- প্রেম- আত্মপ্রসাদ

‘এ-রকম ভুলের বুনোনি- এই অনৃতের প্যারাডিম কেটে
বিপ্লবের নামে এই নৃশংসতা- অহঙ্কার- অন্ধতা চালিয়ে
তবুও নিজেকে ভালো লাগে ব’লে অপরকে মেরে
তবুও বিপ্লব ভালো- ওদের উপরে টেক্কা দিয়ে।’

তবুও বিপ্লব সত্য। যেমন নির্ঘাত সত্য হৃদয়ের পাপ;
যুগে-যুগে পাপী আর বিপ্লবীর ভুল
তবুও এগিয়ে দেয় আমাদের সেই এক সমাজের দিকে:
এখনও সুদূরতম ব’লে আজও বিপ্লবীরা গোক্ষুরা নকুল।