জর্নাল: ১৩৪৬

আজকে অনেক দিন পরে আমি বিকেলবেলায়
তোমাকে পেলাম কাছে;
শেষ-রোদ এখন মাঠের কোলে খেলা করে- নেভে;
এখন অব্যক্ত ঘুমে ভ’রে যায় কাচপোকা মাছির হৃদয়;
নদীর পাড়ের ভিজে মাটি চুপে ক্ষয়
হ’য়ে যায় অক্ষান্ত ঢেউয়ের বুকে;

ঘাসে ঘুমে ক্লান্ত হয়ে আসে ঘুঘু শালিকের গতি;
নিবিড় ছায়ার বুকে ক্রমে-ক্রমে পায় অব্যাহতি
মাঠের সমস্ত রেখা;
ঝাউ-ফল ঝরে ঘাসে- সান্ত্বনার মতো এসে বাতাসের হাত
অশ্বত্থের বুক থেকে নিভিয়ে ফেলছে খাড়া সূর্যের আঘাত;
এখুনি সে স’রে যাবে পশ্চিমের মেঘে।

গোরুর-গাড়িটি কার খড়ের সুসমাচার বুকে
লাল বট-ফলে থ্যাঁতা মেঠো পথে জারুল-ছায়ার নিচে নদীর সুমুখে
কত ক্ষণ থেমে আছে;- চেয়ে দেখ নদীতে পড়েছে তার ছায়া;
নিঃশব্দ মেঘের পাশে সমস্ত বিকেল ধ’রে সে-ও যেন মেঘ এক, আহা,
শান্ত জলে জুড়োচ্ছে;

এই সব নিস্তব্ধতা শান্তির ভিতর
তোমাকে পেয়েছি আজ এত দিন পরে এই পৃথিবীর ‘পর।
দু’ জনে হাঁটছি ভরা প্রান্তরের কোল থেকে আরও দূর প্রান্তরের ঘাসে;
উশখুশু খোঁপা থেকে পায়ের নখটি আজ বিকেলের উৎসাহী বাতাসে
সচেতন হয়ে উঠে আবার নতুন ক’রে চিনে নিতে থাকে
এই ব্যাপ্ত পটভূমি,- মহানিমে কোরালীর ডাকে
হঠাৎ বুকের কাছে সব খুঁজে পেয়ে।
‘তোমার পায়ের শব্দ’, বললে সে, ‘যে-দিন শুনি নি
মনে হতো ব্রহ্মাণ্ডের পরিশ্রম ধুলোর কণার কাছে তবু
কিছু ঋণী; ঋণী নয়?
সময় তা বুঝে নেবে…
সেই সব বাসনার দিনগুলো; ঘাস রোদ শিশিরের কণা
তারাও জাগিয়ে গেছে আমাদের শরীরের ভেতর কামনা
সেই দিন;
মা-মরা শিশুর মতো আকাঙ্ক্ষার মুখখানা কি যে:
ক্লান্তি আনে, ব্যথা আনে, তবুও বিরল কিছু নিয়ে আসে নিজে!’

স্পষ্ট চোখ তুলে সে সন্ধ্যার দিকে: ‘কত দিন অপেক্ষার পরে
আকাশের থেকে আজ শান্তি ঝরে- অবসাদ নেই আর শূন্যের ভিতরে।’

রাত্রি হয়ে গেলে তার উৎসারিত অন্ধকার জলের মতন
কী এক শান্তির মতো স্নিগ্ধ হয়ে আছে এই মহিলার মন!
হেঁটে চলি তার পাশে, আমিও বলি না কিছু, কিছুই বলে না সে;
প্রেম ও উদ্বেগ ছাড়া অন্য-এক স্থির আলোচনা
তার মনে;- আমরা অনেক দূর চ’লে গেছি প্রান্তরের ঘাসে,
দ্রোণ-ফুল লেগে আছে মেরুণ শাড়িতে তার- নিম-আমলকিপাতা হালকা বাতাসে
চুলের ওপরে উড়ে-উড়ে পড়ে- মুখে চোখে শরীরের সর্বস্বতা ভ’রে,
কঠিন এ-সামাজিক মেয়েটিকে দ্বিতীয় প্রকৃতি মনে ক’রে।

অন্ধকার থেকে খুঁজে কখন আমার হাত এক বার কোলে তুলে নিয়ে
গালে রেখে দিলো তার: ‘রোগা হয়ে গেছ এত- চাপা প’ড়ে গেছ- যে হারিয়ে
পৃথিবীর ভিড়ে তুমি-‘, ব’লে সে খিন্ন হাত ছেড়ে দিল ধীরে;
শান্ত মুখে- সময়ের মুখপাত্রীর মতো সেই অপূর্ব শরীরে
নদী নেই- হৃদয়ে কামনা ব্যথা শেষ হয়ে গেছে কবে তার;
নক্ষত্রেরা চুরি ক’রে নিয়ে গেছে, ফিরিয়ে দেবে না তাকে আর।

[চতুরঙ্গ। বৈশাখ ১৩৬১]