কাকজ্যোৎস্না

সেই এক কাকজ্যোৎস্না আছে
হিমানির নদীর ও-পারে
সে-দেশ তো কবির পরাণ
কাঠের ঠেঙোর ‘পরে ভর দিয়ে সারা-রাত
সেই এক কৃকলাস দেশ
হিমানির নদীর ও-পারে
সেইখানে চাঁদ শুষ্ক কঙ্কালের পাহাড়ের পারে আলো
মসৃণ কঠিন ঘাস-শীর্ষ যেন ভুরুর রোমের মতো মৃত ভগিনীর
অমোঘ জ্যোৎস্নার রৌদ্রে হারায়ে ফেলেছে পথ- চির-দিন।

অনেক মানব-আত্মা তবুও সেখানে
প্রবেশের পথ পায়
মুক্ত বৈশাখের বায়ুর তরঙ্গে ভেসে বিচূর্ণ বীজের মতো পটপটি শিমুলের
মৃৎকার্পাসের মতো বিশুষ্ক ধূসর, আহা, প্রান্তরের উতরাই চ’লে গেছে
যত দূর চাঁদ
অস্পষ্ট নীরব
রৌদ্রের জন্ম দেয়
যত দূর- অন্য এক অঘ্রানেরে অরণ্যের থেকে
কাকুতি পাঠাতে চায় পাখি,- এই দিকে
প্লুত সাদা চোখ তুলে মেধাবিনী ভূতের মতন
মৃত সংগীতের মতো
যেন কোন প্রস্তরযুগের পৃথিবীর
অনেক মানব-আত্মা
দাঁড়ায়ে রয়েছে সেইখানে
মৃতদার অগণন সারসপাখির মতো সাদা বিক্ষীণ
সীমাহীন প্রান্তরের বালি ছেয়ে
যত দূর দূরবিন চ’লে যায়
যত দূর গিরগিটি নীরবে লাফায়- জ্যোৎস্না পোহায়-
বিম্বিসার সম্রাটের সৈন্যদের মেধ
কোনও এক প্রাসাদের প্রতিধ্বনি পেয়েছিল
অগ্নি দেখেছিল- জ্ব’লে যায়- দহে না ক’ কিছু
তার পর ম’রে গেছে।

কিন্তু এরা
এরা তবু নির্বাণ নয়
এরা শুধু শীত-রাতে
মৃত্তিকাকে শিকড়ের মতো ভেবে
কামনাকে অন্ধকার গহ্বরে পাঠাতে চায় নেউলের মতন
মাটির পাঁজরে নিচে লুক্কায়িত নদীদের ক্ষত
জলের খনির মত ধূম্র মৌন বিভায় যেখানে
প্যারাফিন-শিখা জ্বালে অজস্র ব্যাঙের চোখে
পীবর- দুর্গন্ধ- হিম-
অসীম আলোকে।
তবু- প্রান্তরের পরে
কঙ্কালের পাহাড়ের পারে স্থির খড়িশুষ্ক চাঁদের আলোকে
যে-সব অনৃত গল্প এক দিন বলেছে জোবেদী
তাই সারাৎসার
চিল মাংস নিয়ে উড়ে যায় মনস্বিনী মেঘের ও-পার
পাথরের ঘেরাটোপে- বিবর্ণ হ্রদের জলে ঘুরে
আমরা শিয়র ছেড়ে জেগে উঠি- বুঝে দেখি নিশীথদুপুরে
আমরা অনেক মীন- আবার এসেছি ফিরে কড়াইয়ের অগ্নি থেকে উড়ে
আবার এসেছি প্লুত পাথরের ঘেরাটোপে
চির-নিশীথের ক্ষীণ জলের প্রকোপে

ইহাদের আত্মা তবু অন্য এক জীবনের বেদি চায়
যেইখানে সূর্যকরোজ্জ্বল
কালো কাক- সাদা ফেনা- সমুদ্রের জল
মাংসপেশি দৃঢ় করে- সুঘ্রাণ জলের খেতে বায়ুর ভিতরে
সারি-সারি পামগাছ নিকেলের ঘড়িদের মতন সফল
(আমাদের নির্বাণ নয়)
বায়ুস্ফীত ফুলকায় হিম- অধিগমনের মীড়
বেজে চলে- কোন আকাশের থেকে নিখাদ শিশির
নিয়ে আসে মৃত তারকার পরাজয়
গভীর প্রণয়ে শ্রোণি কেঁপে ওঠে
অন্তঃসত্ত্বা মাকড়সা নীরবে লাফায়- জ্যোৎস্না পোহায়
তাহাদের উপত্যকা সুমেরীয় বাতাসের মতো মনে হয়।
(নির্বাণ আমাদের নয়)