কে গো তুমি অন্ধকারে

‘কে গো তুমি অন্ধকারে হাঁটছ একা?-‘
উকিল ছিলাম আমি পৃথিবীতে- দেখি আমি কোনও মক্কেলের সাথে হয় যদি দেখা
সব-চেয়ে ভালো লাগে- সব-চেয়ে আমার গরজ
যদি পাই বিপক্ষের খনখনে শরৎ উকিলটাকে- আর সেই রাশভারি নিধু বোস জজ
তবে আমি এখুনি দেখাতে পারি গাউন না এঁটেই
আমি ছাড়া সুধী আসামির বাপ ডাকবার কেউ নেই।
দেখলাম চেয়ে আছে ছায়া ম্রিয়মাণ
ম’রে গেছে পৃথিবীতে তবুও স্বপ্নের থেকে পায় নাই ত্রাণ।

‘কে গো তুমি হাঁটছ একা অন্ধকারে?’
আমি কবি;- কে-বা তুমি এলে এই নরকের পারে
(মার না-কি?) চ’লে যাও- এইখানে প্রেতগুলো আছে
এখানে নক্ষত্র, প্রেম, রূপ নিয়ে ব্যস্ত নিঃসঙ্গতা চাই- নিস্তব্ধতা- এসো না ক’ কাছে
কী বললে ছায়া সব এইখানে? প্রেম নেই- নিষ্ফল পিপাসা?
মৃত্যুর পরের থেকে শকুনের মতো দীর্ঘ ডানা মেলে বৈতরণী-জলে শুধু যাওয়া আর আসা?
অজস্র কবিতা তবু অস্পষ্ট ইশারা নিয়ে অন্ধকারে ভেসে-ভেসে করেছি রচনা
বাসুকি’র মতো এই লক্ষ-লক্ষ কবিতার ফণা
আমাকে ধারণ করে- দোলায়- বিহ্বল করে- দেখলাম ছায়া ম্রিয়মাণ
পৃথিবীতে তবুও স্বপ্নের থেকে পায় নাই ত্রাণ।

‘কে গো তুমি অন্ধকারে একা হাঁটছিলে?’
মনে হয় হাত দিয়ে- হাতের আঙুল দিয়ে যেন তুমি মড়া কাটছিলে
তুমি কে-বা- পৃথিবীর থেকে বুঝি এসেছ, না, নরকের চর?
বলো দেখি- নতুন কী খড়ি-পাতি আঁকা হল পৃথিবীর ‘পর:
অজস্র সমিতি সভা ভাগ-বাঁটোয়ারা ফন্দি ফাঁসা-ফাঁসি- কথা কথা কথার উল্লাস
ফুরুল কি? শুভ শান্তি ভজাল কি? শান্ত সব গাধা ব’সে খায় না কি ঘাস?
আমি যদি পৃথিবীতে থাকতাম নক্ষত্রও প’ড়ে যেত ঝ’রে
তবুও কল্যাণ শান্তি ঐক্য মিল- লম্বা-লম্বা নাম দেয় যত সব বাঁদরে ত্যাঁদড়ে
পৃথিবীর চোখে যেই ধুলো দেয়- র্যাঁদা দিয়ে ফেলতাম সেই সব ইয়ার্কির চাঁট
মানুষ মানুষ আর জাতি জাতি- সকলেরই সেই এক বারোয়ারি ফুর্তির তল্লাট
তা-ই বটে?- অনেক অনেক ব’লে হয়ে গেল ছায়া ম্রিয়মাণ
পৃথিবীতে তবুও স্বপ্নের থেকে পায় নাই ত্রাণ।

‘অন্ধকারে হাঁটছ কে একা-একা তুমি?’
ভয় নেই- মন্দ কি-না নরকের নীল পটভূমি
স্টেথোস্কোপে হাত আছে- এক্স-রে’ও পকেটে আছে
এসো এসো আরও কাছে- এসো আরও কাছে
টনটনে নাড়ি তো তোমার, ভাই- বুক পিঠ সব ঠিক আছে
বলি, শোনো,- কলেজ স্ট্রিটের সেই অবনী রায়’কে চেন? দ্বিতীয় পক্ষের বৌ তার
হল তার জিভে ক্যানসার
চিকিচ্ছে আমার হাতে- ক্যানসার চামুণ্ডা রোগ- এখনও নেই ক’ কোনও নিদেন ওষুধ
গবেষণা নিয়ে আমি ল্যাবরেটরি’তে তাই হয়ে আছি বুঁদ
হঠাৎ সন্ন্যাস-রোগে সটকায়ে পড়েছি এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ধ্ব’সে
বৈতরণী নদীটির বুকে এই- দিন-রাত তবু আমি মনে-মনে দেখছি তো ক’ষে
এত দিনে হল ফাঁস- বলি শোনো- বলতে-বলতে ছায়া হল ম্রিয়মাণ
পৃথিবীতে তবুও স্বপ্নের থেকে পায় নাই ত্রাণ।

‘অন্ধকারে একা তুমি হেঁটে যাচ্ছ কে গো?’
ঝামেলা! কে তুমি এলে? কৈ, চিনি নে গো
গঙ্গা’র উপরে তুমি দেখেছ কি হাওড়া’র পোল?
অথবা তিস্তা’র ‘পরে? শুক্কুর ব্যারেজ?- যাও, কোরো না ক’ মিছে গণ্ডগোল
পৃথিবীতে বেঁচে যদি থাকতাম এক বার পদ্মা মেঘ্না ব্রহ্মপুত্র বেড়ে
বানাতাম সাঁকো- সাঁকো… স্টিল-নীল- এই স্কেচ দেখো… এরোপ্লেনেরে
মামুলি এয়োরোড্রোম থেকে আমি দিতাম খালাস
চেয়ে দেখো- যেমন আকাশে ঐ ওড়ে বুনোহাঁস
আমাদের ওড়াউড়ি আজও, হায়, হয়েছে কি তেমন সহজ
ঘুঘু’র পাখায় চ’ড়ে দমদম থেকে যদি যাও বজবজ
আর যদি ল্যাগব্যাগ লবেজান প্লেনে চড়ো বুঝবে প্রভেদ কত… বলতে বলতে ছায়া হল ম্রিয়মাণ
পৃথিবীতে তবুও স্বপ্নের থেকে পায় নাই ত্রাণ।