কবের সে রাত্রি আজ

কবের সে রাত্রি আজ মনে পড়ে প্রিয়।
হঠাৎ এঞ্জিনরোল স্তব্ধ হ’ল অন্ধকারে এসে
দিল্লীর না লাহোরের বসন্তরাতের টার্মিনাসে,
অপ্রদীপ রাত্রি রীতি অহেতুক উৎসারিত জিনিস হৃদয়ে
ক্লান্ত শরীরের ‘পরে তবু প্রিয় মননের জয়ে
ঈষৎ উৎসবে মেতে হুইলার স্টলের নিকটে বসেছিল
চা খেয়ে দু’-এক কাপ বইগুলো নেড়েচেড়ে
তার পর কখন অনেক রাত হ’লে
মানব আত্মার ক্রান্তি আঁধার সমুদ্র বেয়ে চেনা
ধু-ধু ঢেউদের শোরগোলে
কখন নিজেকে দেখে অচেনা পালকদামে আধা
বিভূষিত পাখি এক ঢেউয়ের উঠতি পথে সাদা
চাঁদের আলোয় দূর সুমুখের সমুদ্র নির্জন পরিষ্কার।
সাগরের পাড় দিয়ে দূর দিগন্তের টেলিগ্রাফ তার।
অথবা তা স্নিগ্ধ এক বাতাসের সুর;
সময় চলেছে নিজ পথ কেটে বাতাসের মতন বিধুর
সেখানে প্রেমের কোনও কথা
পৃথিবীর শারীরিকতায় প্রিয় নারীমুখ কেউ
সৈকতের স্পর্শহীন চাঁদের দুয়ারে দূরে র’য়ে গেছে ব’লে
কবেকার অ্যামিবার নীড় ভেঙে ঋজু নীল সমুদ্রের ঢেউ
মানবজাতির চোখে কেঁপে উঠে আজ
দেখাতেছে কা’কে বলে প্রকৃতির বিচ্ছেদের রাত
অথবা তা সমাজের প্রেমিকের হৃদয়ের…
এই সব অবিচ্ছিন্ন অনুভব অন্ধকারে থামবে হঠাৎ
কখন দাঁড়ালে তুমি নারীর মতন কেশপাশে।

নারী তুমি আমার না অপরের?
কাহার পায়ের সুর যেন নেমে আসে
তোমার চোখের সুরে- অপরের অথবা আমার?
বাতাসে অগুরু গন্ধ ভেসে ওঠে বাতিহীন রাতে
মৃত যারা ম’রে গিয়ে অন্ধ স্নিগ্ধ দিকপ্রান্তে সব
সময়ের বিছানায় শুয়ে আছে সব ক্ষোভ ভুলে
তাদের প্রশান্তি এই মেয়েটির আজানুলম্বিত ঘন চুলে
মৃতদের কাছ থেকে এ-রকম স্বাভাবিক ঋণ
সহজে গ্রহণ ক’রে নারী
দাঁড়ায়ে রয়েছে সাদা সুধাস্পর্শসাক্ষরিত হ’য়ে
কোটি কাল আগে আমি পৃথিবীতে সেই এক শরীর ছিলাম
যেই এক শরীরিণী জীবনীকে চেয়ে
অনেক নক্ষত্র ক্রান্তি শেষ ক’রে সময়ের রূপ ভেঙে গ’ড়ে
সে আজ নিকটে এসে দাঁড়ায়েছে অগণ্য আঁধার
ভেঙে ফেলে পুনরায় অন্ধকারে দাঁড়াবার সাধ
যেই সব দূর দূর দূরতার নক্ষত্রের
তাদের শখের মতো মেয়েটির গভীর চুম্বক
সৃজনের শোকাবহ অন্ধকারে কান পেতে কোন্ দূর অবক্ষয়ধূসর তারাকে
নিজের অভ্রান্ত একা আয়ুহীন কক্ষলোকে ডাকে

সেই নারী- কোথাও যুবক বুঝি বিশৃঙ্খল অন্ধকারে তাকে
নিয়ে গেছে- নিয়ে যাবে- নিয়ে যেতে পারে-
টার্মিনাসে মরু দিল্লীর রাত ভেঙে ফেলে আমরা দু’জন
নক্ষত্রের পথে অন্য নক্ষত্রের আলোকবর্ষের সহ-অসহমরণ
প্রতিভাত ক’রে নিয়ে নেমে গেছি কিছু দূর পৃথিবীর অসুখে আলোকে
হাতে তার দু’-চারটে বই, স্টলের চায়ের
ঈষৎ সুমিষ্ট ঘ্রাণ- হৃদয়ে অ্যামিবা ঊর্মিময় এক নীল
সাগর অনন্তকাল পথ চ’লে আজ গভীর ফেনিল
মানুষের প্রমিতির মৃত পত্রে নীলোচ্ছ্বাস হ’য়ে গেছে ব’লে বুঝি
ব্যথায় আতুর হ’য়ে বলেছিলে ‘প্রিয়’
আমাকে না আমাদের দু’জনের পাশে যে তৃতীয়
যুবক দাঁড়ায়েছিল তাকে?
অনাথ অঙ্গার হ’য়ে সৃজনের দ্রুত অন্ধকারে
আমার মতন যুবা- হাতে ধরা মোমের বাতির মতো জ্ব’লে
উঠে যেতে-যেতে চুপে অনন্ত সরল বক্র সিঁড়ির দু’-ধারে
দেখেছি বেপথুমান মানবের মহামানবের যান
ক্রমাগত নিভে যেতে থাকে
তার পর দেখেছিল দেখেছি যে সূর্যচক্ষে
সংক্রান্তির সবিতার মতন তোমাকে।

জলসা। শারদীয় ১৩৭৫