কবি

ভ্রমরীর মতো চুপে সৃজনের ছায়াধূপে ঘুরে মরে মন
আমি নিদালির আঁখি, নেশাখোর চোখের স্বপন!
নিরালায় সুর সাধি, বাঁধি মোর মানসীর বেণী,
মানুষ দেখে নি মোরে কোনোদিন, আমারে চেনে নি!
কোনো ভিড় কোনোদিন দাঁড়ায় নি মোর চারিপাশে,-
শুধায় নি কেহ কভু-‘আসে কি রে,- সে কি আসে- আসে!’
আসে নি সে ভরাহাটে খেয়াঘাটে- পৃথিবীর পসরার মাঝে,
পাটনী দেখে নি তারে কোনোদিন- মাঝি তারে ডাকে নিকো সাঁঝে।
পারাপার করে নি সে মণিরত্ন- বেসাতির সিন্ধুর সীমানা,-
চেনা-চেনা মুখ সবই- সে যে শুধু সুদূর- অজানা!

করবীকুঁড়ির পানে চোখ তার সারাদিন চেয়ে আছে চুপে,
রূপ সাগরের মাঝে কোন্ দূর গোধূলির সে যে আছে ডুবে!
সে যেন ঘাসের বুকে, ঝিলমিল শিশিরের জলে;
খুঁজে তারে পাওয়া যাবে এলোমেলো বেদিয়ার দলে,
বাবলার ফুলে-ফুলে ওড়ে তার প্রজাপতি-পাখা,
ননির আঙুলে তার কেঁপে ওঠে কচি নোনাশাখা!
হেমন্তের হিম মাঠে, আকাশের আবছায়া ফুঁড়ে
বকবধূটির মতো কুয়াশায় শাদা ডানা যায় তার উড়ে!
হয়তো শুনেছ তারে- তার সুর, দুপুর আকাশে
ঝরাপাতা ভরা মরা দরিয়ার পাশে
বেজেছে ঘুঘুর মুখে, জল-ডাহুকীর বুকে পউষনিশায়
হলুদ পাতার ভিড়ে শিরশিরে পুবালি হাওয়ায়!

হয়তো দেখেছ তারে ভূতুড়ে দীপের চোখে মাঝরাতে দেয়ালের ‘পরে
নিভে-যাওয়া প্রদীপের ধূসর ধোঁয়ায় তার সুর যেন ঝরে!
শুক্লা একাদশী রাতে বিধবার বিছানায় যেই জ্যোৎস্না ভাসে
তারই বুকে চুপে-চুপে কবি আসে- সুর তার আসে!
উসখুস্ এলো চুলে ভ’রে আছে কিশোরীর নগ্ন মুখখানি,-
তারই পাশে সুর ভাসে- অলখিতে উড়ে যায় কবির উড়ানি!

বালুঘড়িটির বুকে ঝিরি-ঝিরি-ঝিরি-ঝিরি গান যবে বাজে
রাতবিরেতের মাঠে হাঁটে সে যে আলসে, অকাজে!
ঘুমকুমারীর মুখে চুমো খায় যখন আকাশ,
যখন ঘুমায়ে থাকে টুনটুনি, মধুমাছি, ঘাস
হাওয়ার কাতর শ্বাস থেমে যায় আমলকী ঝাড়ে,
বাঁকা চাঁদ ডুবে যায় বাদলের মেঘের আঁধারে,
তেঁতুলের শাখে-শাখে বাদুড়ের কালো ডানা ভাসে,
মনের হরিণী তার ঘুরে মরে হাহাকারে বনের বাতাসে!

জোনাকির মতো সে যে দূরে-দূরে যায় উড়ে-উড়ে-
আপনার মুখ দেখে ফেরে সে যে নদীর মুকুরে!
জ্ব’লে ওঠে আলেয়ার মতো তার লাল আঁখিখানি।
আঁধারে ভাসায় খেয়া সে কোন্ পাষাণী!

জানে না তো কী যে চায়- কবে হায় কী গেছে হারায়ে।
চোখ বুজে খোঁজে একা- হাতড়ায় আঙুল বাড়ায়ে
কারে আহা।- কাঁদে হা হা পুবের বাতাস,
শ্মশানশবের বুকে জাগে এক পিপাসার শ্বাস!
তারই লাগি মুখ তোলে কোন্ মৃতা- হিম চিতা জ্বেলে দেয় শিখা,
তার মাঝে যায় দহি বিরহীর ছায়াপুত্তলিকা!