চিঠি-১

৩রা পৌষ ১৩৩৭ [?]
66 Harrison Road, Calcutta.

শ্রীচরণেষু,

আপনার স্নেহাশিস লাভ করে অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আজকালকার বাংলাদেশের নবীন লেখকদের সব চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য এই যে মাথার ওপরে স্পষ্ট সূর্যালোকের মতো আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীকে তারা পেয়েছে। এত বড়ো দানের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে হলে যতখানি গভীর নিষ্ঠার দরকার দেবতার পূজারীকে কখনও তার থেকে বঞ্চিত করেন না। কিন্তু এ দানকে ধারণ করতে হলে যে শক্তির প্রয়োজন তার অভাব অনুভব কচ্চি। অক্ষম হলেও শক্তির পূজা করা এবং শক্তির আশীর্বাদ ভিক্ষা করা আমার জীবনের সব চেয়ে বড়ো সাধনা। আর আমার জীবনের আকিঞ্চন সেই আরাধ্য শক্তি ও সেই কল্যাণময় শান্তির উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। আশা করি এর থেকে আমি বঞ্চিত হব না।

পত্রে আপনি যে কথা উল্লেখ করেছেন সেই সম্পর্কে দু-একটা প্রশ্ন মনে আসছে। অনেক উঁচু জাতের রচনার ভেতর দুঃখ বা আনন্দের একটা তুমুল তাড়না দেখতে পাই। কবি কখনও আকাশের সপ্তর্ষিকে আলিঙ্গন করবার জন্য উৎসাহে উন্মুখ হয়ে ওঠেন- পাতালের অন্ধকারে বিষজর্জর হয়ে কখনও তিনি ঘুরতে থাকেন। কিন্তু এই বিষ বা অন্ধকারের মধ্যে কিম্বা এই জ্যোতির্লোকের উৎসের ভেতরেও প্রশান্তি যে খুব পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে তা তো মনে হয় না। প্রাচীন গ্রীকেরা serenity জিনিসটার খুব পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁদের কাব্যের মধ্যেও এই সুর অনেক জায়গায় বেশ ফুটে উঠেছে। কিন্তু যে জায়গায় অন্য ধরনের সুর আছে, সেখানে কাব্য ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে হয় না। দান্তের Divine Comedyর ভেতর কিম্বা শেলীর ভেতর serenity বিশেষ নেই। কিন্তু স্থায়ী কাব্যের অভাব এঁদের রচনার ভেতর আছে বলে মনে হয় না। আমার মনে হয় বিভিন্ন রকমের বেষ্টনীর মধ্যে এসে মানুষের মনে নানা সময় নানারকম moods খেলা করে। সে mood-গুলোর প্রভাবে মানুষ কখনও মৃত্যুকেই বঁধু বলে সম্বোধন করে, অন্ধকারের ভেতরেই মায়ের চোখের ভালোবাসা খুঁজে পায়, অপচয়ের হতাশার ভেতরই বীণার তার বাবার ভরসা রাখে। যে জিনিস তাকে প্রাণবন্ত করে তোলে অপরের চোখে হয়তো তা নিতান্তই নগণ্য। তবু তাতেই তার প্রাণে সুরের আগুন লাগে,-সে আগুন সবখানে ছেয়ে যায়। Moodএর প্রক্রিয়ায় রচনার ভেতর এই যে সুরের আগুন জ্বলে ওঠে, তাতে serenity অনেক সময়েই থাকে না- কিন্তু তাই বলেই তা সুন্দর ও স্থায়ী হয়ে উঠতে পারবে না কেন বুঝতে পারছি না।

সকল বৈচিত্র্যের মতো সুরবৈচিত্র্যও আছে সৃষ্টির ভেতর। কোনো একটা বিশেষ ছন্দ বা সুর অন্য সমস্ত সুর বা ছন্দের চেয়ে বেশি করে স্থায়ী স্থান কী করে দাবি করতে পারে। আকাশের নীল রঙ, পৃথিবীর সবুজ রঙ, আলোর শেত রঙ কি অন্ধকারের কালো রঙ-সমস্ত রঙগুলিরই একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ আছে। একটিকে অনাটির চেয়ে বেশি সুন্দর ও সুচির বলা চলে ব’লে মনে হচ্ছে না। এই অন্ধকার, এই আলো, আকাশের নীল, পৃথিবীর শ্যামলিমা-সবই তো সুচির, সুন্দর। সৌন্দর্য ও চিরত্বের বিচার তাই একটু অনা ধরনের বলে মনে হয়। ঘুড়ির কাগজের সবুজ, নীল, শাদা বা কালো রঙ যখন পৃথিবী, আকাশ, প্রভাত বা রাত্রির বর্ণের সৌন্দর্য ও স্থায়িত্বের দাবি করে বসে, তখন আর কোনো প্রসঙ্গের প্রয়োজন থাকে না। আমার তাই মনে হয়, রচনার ভেতর যদি সত্যিকারের সৃষ্টির মর্যাদা থাকে তা হলে তার ভেতরকার বিশিষ্ট সুরের প্রশ্নটি হয়তো অবহেলাও করা যেতে পারে। শান্তি বা serenityর সুরে কবিতা বেঁধেও সত্যিকারের সৃষ্টির প্রেরণার অভাব থাকলে হয়তো তাও নিষ্ফল হয়ে যায়।

বীঠোফেনের কোনো কোনো symphony বা sonataর ভেতর অশান্তি রয়েছে, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু আজও তো টিকে আছে-চিরকালই থাকবে টিকে, তাতে সত্যিকার সৃষ্টির প্রেরণা ও মর্যাদা ছিল বলে।

আমার যা মনে হয়েছে, তাই আপনাকে জানিয়েছি। আপনার অন্তরললাকের আলোপাতে আমার ত্রুটি ও অক্ষমতাকে মার্জিত করে নেবেন আশা করি। আপনার কুশল প্রার্থনীয়। আপনি আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করুন।

প্রণত
জীবনানন্দ দাশ


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা চিঠি, পৌষ ১৩৩৭ [?]