চিঠি-২

Sarbananda Bhavan
Barisal
2. 7. 37

শ্রীচরণেষু,

এত দিনে ‘ভারতবর্ষ’ যোগাড় করতে পারলাম। সেই জন্যে আপনাকে চিঠি লিখতে দেরি হয়ে গেল। কলকাতায় থাকলে পাঁচ মিনিটে যে জিনিস পাওয়া যেত, এখানে তা পেতে এক সপ্তাহের বেশি লেগে গেল। মফস্বলের এই শহরগুলো এখনও নানা দিক দিয়ে intellectual backwater হয়ে আছে। এখানে culture জিনিসটা একরকম নেই বল্লেই হয়। সাহিত্যসৃষ্টি তো দূরের কথা, সাহিত্যচর্চাও খুব কম লোকেই করে। সেই জন্যেই কলকাতায় কোনো কাজ নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে, এই আবহাওয়ার ভিতর মন আর টিকে থাকতে চায় না।

আপনার ‘বীণাবাই’ আমার খুবই ভালো লাগল। আপনি আগে যে গল্প লিখেছেন আমি তা পড়ে এসেছি; এবং আপনার গল্প লিখবার স্বতন্ত্র ও উৎকৃষ্ট প্রণালীর বাহবা দিয়েছি মনে মনে। আপনার ‘চার-ইয়ারী কথা’ প্রথম যখন আমার হাতে এসেছিল, তখন আমি বালক মাত্র। তখনকার দিনে রবীন্দ্রনাথ ও প্রভাত মুখুয্যের গল্পের আওতা ছিল বেশি; ‘ভারতী’ পত্রিকার মারফৎ গল্পসাহিত্যের একটা নতুন স্কুল কিছু প্রত্যাশা দিচ্ছিল হয়তো। বিমুগ্ধ ও চমকৃত হয়ে তখন হঠাৎ একদিন আপনার ‘চার-ইয়ারী কথা’ পাঠ করলাম। Keatsএর ভাষায় বলতে গেলে “Then felt I like some watcher of the skies when a new planet swims into his ken’, অনুভব করতে পারলাম প্রবন্ধসাহিত্যেও যেমন কথাসাহিত্যেও তেমনি আপনার রচনা যেন মানুষের মননের তীক্ষ্ণ ও সরস ক্রীড়াভূমির মতো সমস্ত সৃষ্টির আস্বাদ নিয়ে এই প্রথম জন নিল। আমি পূর্বের পত্রে আপনাকে লিখেছি যে বাংলাসাহিত্যের যে কোনো বিভাগ আপনি স্পর্শ করেছেন- প্রবন্ধ, সমালোচনা, গল্প, সনেট ইত্যাদি সেখানেই আপনার অনন্যসাধারণ লিপিচাতুরী ও স্বতন্ত্র মনীষার ছাপ রেখে গেছেন আপনি। ‘চার-ইয়ারী কথা’ পড়ে তখন মনে করেছিলাম যে আপনি আরো বড়ো বড়ো উপনাস লিখবেন। কিন্তু তা লিখলেন না। প্রবন্ধ ও সমালোচনার ভিতরেই আপনি আপনার সমস্ত প্রতিভা ঢেলে দিলেন। এ ভালোও হল- কিন্তু কয়েকখানা বড়ো বড়ো উপন্যাস লিখে বাংলা কথাসাহিত্যকে যে আপনি অলক্ষিতপূর্ব্ব রূপ, গভীরতা (আপনার গল্প কখনই ফিলজফি-বর্জিত নয়), ও প্রসার দিতে পারতেন আপনার তরফ থেকে সে জাতীয় প্রচেষ্টার অভাব আমাকে থেকে থেকে পীড়িত করে তুলত। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছি বড়ো উপন্যাসই হোক, কিংবা ছোটো গল্পই হোক লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিই হচ্ছে আসল জিনিস। এবং এ জিনিসের নব ও নবতর দক্ষতার সূচক পরিণতিতে আপনি অপ্রতিদ্বন্দী। শ্রেষ্ঠ লেখকদের একটা বিশেষ গুণ এই যে তারা তাদের সাহিত্যসৃষ্টির স্তরে স্তরে তাদের পূর্বতন রচনাবৈশিষ্ট্যের প্রতিধ্বনি মাত্র করতে যান না; নিজেদের লেখা ছাড়িয়ে যাবার, নূতনতর সৃষ্টি করবার আশ্চর্য ক্ষমতা থাকে তাঁদের। আপনার ‘বীণাবাই’ গল্পে তারই প্রমাণ পেলাম। ঘোষালের মুখ দিয়ে ইদানীং আপনি অনেক গল্প বলিয়ে নিচ্ছেন। এ সব গল্প আপনার আগেকার গল্পগুলোর মতো নয়; আপনার জীবন্ত স্রষ্টামনের নব নব পরিণতির পরিচায়ক। এই হচ্ছে সম্যক্ প্রতিভার লক্ষণ। এই সম্পর্কে একটা pertinent কথা বলছি;- অপরাধ নেবেন না। এই আষাঢ় সংখ্যার ‘ভারতবর্ষে’ শরৎবাবুর ‘দেওঘরের স্মৃতি’ পড়লাম। শরৎবাবুর ও রচনাটি তাঁর পুরোনো লেখারই পুনরুক্তি মাত্র। শরৎবাবু যেন নিজের লেখাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন না আর। একটা মস্ত obsession এসে তাঁকে বাধা দেয়। পরন্তু রবীন্দ্রনাথ ও আপনি এরকম বাধায় ব্যাহত হন না। বরং সেই জন্যই আপনাদের শ্রেষ্ঠতা তর্কের অতীত।

ঘোষালের গল্পগুলোর সম্বন্ধে আপনার সঙ্গে বিশদ আলোচনা করবার ইচ্ছা আমার আছে। কোনোরকমে কলকাতায় কোনো collegeএ চাকরী নিয়ে বসতে পারলে সুবিধে হত। Ripon Collegeএর ইংরেজির staffএ আপনি যদি আমার জন্য একটা জায়গা করে দেন তা হলে আমার বড়ো উপকার হয়। Mr. J. choudhury ও Mr. Bhavasankar Banerjeeকে আপনি যদি একটু বিশেষভাবে বলেন তা হলেই সব হয়ে যায়। এখনই নতুন session আরম্ভ হবে; আজকালই নতুন লোক নিযুক্ত কবার সময়।

ভাদ্রের ‘বিচিত্রা’য় ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র সম্বন্ধে আপনি লিখবেন জেনে অব্দি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে আছি। সমালোচনাটি ‘পুস্তক পরিচযে’র no-man’s land এর ভিতর না দিয়ে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ আকারে লিখলে ভালো হয়। আমি খুব খুশি হব। কলকাতার গরম আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমার মনে হয় কিছুদিন আপনি কোনো ঠাণ্ডা জায়গায় বেড়িয়ে এলে শরীরে নবীন আস্বাদ ফিরে আসবে আবার। আজ এই পর্যন্ত।

Ripon collegeএ একটা ব্যবস্থা করে দেয়ার ভার আপনার ওপরে- দয়া করে মনে রাখবেন। সামান্য মাইনেতেও আমি যেতে প্রস্তুত। কারণ কলকাতায় থাকাই প্রধান উদ্দেশ্য।

আপনার সর্বাঙ্গীণ কুশল প্রার্থনা করি। আপনি আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করুন।

ইতি-
স্নেহাকাঙ্ক্ষী জীবনানন্দ


প্রমথ চৌধুরীকে লেখা।