মাঝসমুদ্রের জলে

মাঝসমুদ্রের জলে আমরা চলিতে আছি বহু দিন ধ’রে
কর্মঠ মিস্ত্রিরা এই নিরঙ্কুশ জাহাজেরে করেছে নির্মাণ
তারা এই পৃথিবীর সমর-যন্ত্রের সব সঙ্গত বৃত্তিতে বুদ্ধিমান
‘তবু এই জাহাজের ওয়্যারলেসে শান্তি শুধু- স্টিমে সব জোর
ভুতুড়ে জাহাজ নয় ভ্রাম্যমাণ ওলন্দাজ নাবিকের-
নাই এর কল্পনা প্রখর-‘
উদগারিছে সিন্ধু যেন; কুষ্ঠধবল এক দানবের জ্যোতির্ময় হাসি
মুখে তার;- একটি লাঠির ‘পরে ভর দিয়ে উঠিছে উদ্ভাসি
মেঘের ও-পারে গিয়ে অবিরল মনোরম দানবীয়তায়
আরোহীরা ডিম খায়- জরায়ুর কাজ করে- দিবসের পিংপং খেলা ভুলে যায়
টিন-সৈন্যদের মতো শুয়ে থেকে সারি-সারি
কোনও এক বালিকার প্যাঁটরার তুলোর ভিতরে

নির্জন বাতাসে তবু জাহাজের তার্পুলিন নড়ে।
সুন্দর বাতাস এই প্রশান্ত সমুদ্র থেকে আসিয়াছে- ধবল পাখির পিঠে চ’ড়ে
তবু জানি অদিতি জননী ব’লে যেই নীলিমারে মোরা কাছে ডাকি
এ-হাওয়াও তেমনই জননী
শান্ত- স্থির- পারাপারহীন- নীল- প্রোটিয়ান-
অদূরে বন্দর আছে হয়তো-বা- জ্যোৎস্নায়-
সঙঘারামে শোনা যায় তথাগত-শিষ্যার করুণার গান
তবু তার-ই আগে যেন সমুদ্রের মকরেরা
আনন্দে শুনিতে পাবে মানবী ও শিশুদের ক্রন্দনের ধ্বনি
টিনের পুতুল, স্টিল, ওয়্যারলেস, তোমার বিস্তৃত পাণিতলে তারা আমলকী
জানি আমি সভ্যতার চর্ম ছিঁড়ে তুমি এক নব আবরণে
তাহারে প্রদীপ কর;- তবু আমি তাকাব না বহু ক্ষণ তোমার আননে।

আরও কাছে সঙঘারামে শোনা যায় তথাগত-শিষ্যার প্রণয়ের গান
হয়তো-বা তা-ই তুমি নিগূঢ় বায়ুর সাথে বহি
আসন্ন মৃত্যুর গন্ধে শীর্ণ বাদুড়ের মতো এই জাহাজেরে মেঘের নিকটে তুলে নিয়ে
সমুদ্রের অন্ধকার পুরুভুজ-বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দেবে তারে
গুঁড়ো-গুঁড়ো কঙ্কাল-কঞ্চির মতো
অচল অভ্যাসে তারা সমুদ্র-ঘড়ির শব্দে দুলে-দুলে সমস্ত সময়- রাত রহিবে নিরত
জীবনের কাজ থেকে
আমাদের প্রেমিকারা অনেক ধূসর বই প’ড়ে ফেলে ক্রমে-ক্রমে সন্নিবদ্ধ রীতি
শিখিতেছে;- তারে তারা মহীয়ান ব’লে জানে;- আমরা সংস্থিতি
ভালোবাসি;- আমাদের মনীষীরা অনুকূল চোখ নিয়ে চেয়ে দেখে
মেঠো-পেঁচা বুনিতেছে নীড়;
বাংলা’র- কিংবা দূর ইটালি’র- আব্রুৎসি’র কৃষকেরা বুনিতেছে ধান;
তবুও আশ্চর্য হাওয়া চ’লে আসে
যেন কোনও আমাদের প্রতিভার মতো নয়- আপনারে নীলিমা প্রকাশে
শান্ত- স্থির- পারাপারহীন- নীল- নীল- স্থির- প্রোটিয়ান।