মাঠের গল্প

মেঠো চাঁদ
মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে
আমার মুখের দিকে,- ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়ো জমি,- খড়- নাড়া- মাঠের ফাটল,
শিশিরের জল!
মেঠো চাঁদ,- কাস্তের মতো বাঁকা, চোখা-
চেয়ে আছে;- এমনি সে তাকায়েছে কত রাত,- নাই লেখা-জোখা।
মেঠো চাঁদ বলে:
‘আকাশের তলে
খেতে-খেতে লাঙলের ধার
মুছে গেছে,- ফসল কাটার
সময় আসিয়া গেছে,- চ’লে গেছে কবে!-
শস্য ফলিয়া গেছে,- তুমি কেন তবে
রয়েছ দাঁড়ায়ে
একা-একা!- ডাইনে আর বাঁয়ে
খড়-নাড়া- পোড়ো জমি- মাঠের ফাটল,-
শিশিরের জল!’…
আমি তারে বলি:
‘ফসল গিয়েছে ঢের ফলি,
শস্য গিয়েছে ঝ’রে কত,-
বড়ো হ’য়ে গেছ তুমি এই বুড়ি পৃথিবীর মতো!
খেতে-খেতে লাঙলের ধার
মুছে গেছে কত বার,- কত বার ফসল-কাটার
সময় আসিয়া গেছে,- চ’লে গেছে কবে!-
শস্য ফলিয়া গেছে,- তুমি কেন তবে
রয়েছ দাঁড়ায়ে
একা-একা!- ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়ো জমি,- খড়- নাড়া- মাঠের ফাটল,-
শিশিরের জল!’

পেঁচা
প্রথম ফসল গেছে ঘরে,-
হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে
শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে
হিম হয়ে আসে
বাঁশ-পাতা- মরা ঘাস- আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!
ধান-খেতে- মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা!
ঘরে গেছে চাষা;
ঝিমায়াছে এ-পৃথিবী,-
তবু পাই টের
কার যেন দু’টো চোখে নাই এ-ঘুমের
কোনও সাধ!
হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে,
শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে,
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জাগে একা অঘ্রানের রাতে
সেই পাখি;-
আজ মনে পড়ে
সে-দিনও এমনি গেছে ঘরে
প্রথম ফসল;-
মাঠে-মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর,-
কার্তিক কী অঘ্রানের রাত্রির দুপুর!-
হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে,
শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে,
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে,
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জেগেছিল অঘ্রানের রাতে
এই পাখি!
নদীটির শ্বাসে
সে-রাতেও হিম হয়ে আসে
বাঁশ-পাতা- মরা ঘাস- আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!
ধান-খেতে- মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা!
ঘরে গেছে চাষা;
ঝিমায়াছে এ-পৃথিবী,-
তবু আমি পেয়েছি-যে টের
কার যেন দু’টো চোখে নাই এ-ঘুমের
কোনও সাধ!

পঁচিশ বছর পরে
শেষ-বার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে-
বলিলাম,- ‘এক দিন এমন সময়
আবার আসিয়ও তুমি,- আসিবার ইচ্ছা যদি হয়!-
পঁচিশ বছর পরে!’
এই ব’লে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে;
তারপর, কত বার চাঁদ আর তারা,
মাঠে-মাঠে ম’রে গেল, ইঁদুর-পেচাঁরা
জ্যোৎস্নায় ধান-খেত খুঁজে
এল-গেল।- চোখ বুজে
কত বার ডানে আর বাঁয়ে
পড়িল ঘুমায়ে
কত-কেউ!- রহিলাম জেগে
আমি একা;- নক্ষত্র যে-বেগে
ছুটিছে আকাশে,
তার চেয়ে আগে চ’লে আসে
যদিও সময়,-
পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!-
তারপর,- এক দিন
আবার হলদে তৃণ
ভ’রে আছে মাঠে,-
পাতায়, শুকনো ডাঁটে
ভাসিছে কুয়াশা
দিকে-দিকে, চড়ুয়ের ভাঙা বাসা
শিশিরে গিয়েছে ভিজে,- পথের উপর
পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা- কড়্-কড়্!
শসা-ফুল,- দু’ একটা নষ্ট সাদা শসা,-
মাকড়ের ছেঁড়া জাল,- শুকনো মাকড়সা
লতায়- পাতায়;-
ফুটফুটে জ্যোৎস্না-রাতে পথ চেনা যায়;
দেখা যায় কয়েকটা তারা
হিম আকাশের গায়,- ইঁদুর-পেঁচারা
ঘুরে যায় মাঠে-মাঠে, খুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজও মেটে,
পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে!

কার্তিক মাঠের চাঁদ
জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ,-
পাহাড়ের মতো ওই মেঘ
সঙ্গে ল’য়ে আসে
মাঝ-রাতে কিম্বা শেষ-রাতের আকাশে
যখন তোমারে!
-মৃত সে-পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিল যারে!
ছেঁড়া-ছেঁড়া সাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে
তরাসে ছেলের মতো,- আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে
অনেক সময়,-
তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে,- চাঁদ;-
পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়,
এক দিন হয়েছে যা,- তারপর হাতছাড়া হ’য়ে
হারায়ে ফুরায়ে গেছে,- আজও তুমি তার স্বাদ ল’য়ে
আর-এক বার তবু দাঁড়ায়েছ এসে!
নিড়োনো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চার দিকে,
শস্যের খেত চ’ষে-চ’ষে
গেছে চাষা চ’লে;
তাদের মাটির গল্প- তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হ’লে
অনেক তবুও থাকে বাকি-
তুমি জান- এ-পৃথিবী আজ জানে তা কি!