মেঘ ক’রে আসে

আমি:
মেঘ ক’রে আসে, দ্যাখো- এই বার সব বই রুদ্ধ ক’রে
সব কথা-বার্তা ঐ জামের অরণ্যে মক্ষিকার তরে রেখে
লবেজান সিঁড়ি বেয়ে নিচে আমি নেমে যাব- ল্যাম্প ধরো-

সে:
নিচে? কোন দিকে? কেন?
আশ্চর্য বাতাস মোরা পান করি এইখানে
যেন দু’টো সমুদ্রের চিল বৃহস্পতি-নক্ষত্রের নিচে এসে
ধবল মেঘের দুর্গের চূড়ার ‘পরে ব’সে
পৃথিবীর বয়সকে ভুলে গেছে

আমি:
কোনও দিন মরণের পরে- হয়তো-বা মৃত্তিকার অন্ধকারে
কিংবা কোনও প্রিয় স্বজনের কাচের বৈয়মে শুয়ে আমাদের হাড়
মমি’র মতন শান্তি পাবে- ভুলে যাবে- সকলকে ভুলিতে বলিবে
জাগরূক বলিরেখা ঘিরে যত প্রশ্ন- জিঘাংসা জমেছে
কিংবা তারা জানে
হয়তো-বা আত্মারাম মুস্তফি’র মতো
বিবর্ণ পকেট থেকে হঠাৎ লাফায়ে উঠে
আরও কিছু ভেল্কির বিনিয়োগ আছে আমাদের
কিন্তু- তবু- যত দিন বেঁচে আছি লাইব্রেরি’র নেপথলিন কড়িবর্গার বায়ু ঘ্রাণে
কতগুলো আক্ষেপ- অনবধান যেন-
কর্নিশের পাখির মতন-
আলোর ভিতর থেকে উড়ে আসে- অন্ধকারে নিভে যায়
অন্ধকার থেকে উঠে এসে জ্যোতির্গময় ব’লে যায় উড়ে
যেন কোন সেগুন-বীথির হেঁয়ালির দিকে
শ্যাময়-লেদার’এ তবু চশমার কাচ ঘ’ষে চেয়ে দেখি
যেন এক দক্ষিণা হাওয়ায়- শিমুল-অরণ্য থেকে অজস্র ফুলের মতো
ছিটেগুলি খেয়ে তাহাদের শব
কুষ্ঠরুগিনির নিরঙ্কুশ জঘনের মতো
প্রাঞ্জল আঁধারে পচিতেছে

সে:
এ-সব আমার বিষয় নয়

আমি:
আমারও বিষয় নয় এই সব
যত দিন আঁকাবাঁকা হাঙরের দাঁতের মতন সিঁড়ি বেয়ে
এই লাইব্রেরি-দুর্গে প্রবেশের পথ আছে
ফেরারির মতো আমি দিনদুপুরের জনরব থেকে
অনুতপ্ত আত্মা ল’য়ে; পুঁজ ল’য়ে
ইশফগুলের ভিজে পুলটিশ
সহসা স্খলিত হয়
কোথায় অদৃশ্য হব- কে-বা জানে।

সে:
আমি জানি এই নেপথলিন-গাঢ় অন্ধকারে তোমাকে আসিতে হবে।

আমি:
কিংবা কোনও ক্যানসার-আশ্রমে।
চল্লিশ বছর কাল কেটে গেছে জীবনের রাক্ষুসে ঢ্যাঁড়শ খেয়ে
ওঁচা চামারের দোকানের থেকে
ভাগাড়ের গোরুর চামড়া কিনে- বিপরীত মুচির পরখের জুতো
টাইট ক’রে নিয়ে।

বর্মা-চুরুট টেনে কেরোসিন-কাঠের চেয়ারে ব’সে
আমরা ক’জন ছাড়া পোলিটিক্স আর কেউ শিখেছিল?
আ-হা, সেই সব গরম পাঁপড়-ভাজা- চায়ের পেয়ালা- কালো চুরুটের দিন-

হে শত্ৰু, গভীর শত্রু, ক্ষমা করো- কোনও ক্রোধ-
তোমার সিংহী’র মতো সুন্দর- ভীষণ মুখে জাগাতে যেয়ো না আর মিছে
কয়েকটা অসংলগ্ন মণি শুধু আছে আজ- বুকের পকেটে-
তাহাদের সিন্ধুবায়সের মতো প্রতিভাকে নীড়ের ভিতরে টেনে নিতে
মেধাবী সূত্রের অভিমান
নাই আর।

সে:
লাইব্রেরি আছে, বিবাহিত জীবনের সন্ততিরা- নারী আছে- চাকরি রয়েছে-

আমি:
যেই সব হিজলের কাঠ- ক্যানভাস- জড়ো ক’রে গেছি এত দিন
জীবনের যকৃৎ বিকল হ’লে- গোধূলির অন্ধকারে
পরিপক্ক ডেকচেয়ারের তরে
অদ্ভুত গণিতে যেন তারা সব মাঝপথে- ঢোঁক গিলে
স্ট্রেচারের মতো হয়ে গেল।
কোনও এক ক্যানসার-আশ্রমে চ’লে গেছি
দু’-একটা লেমনেড খাওয়া যায়
আসর জমানো যায় ধার্তরাষ্ট্রদের নিয়ে
এক কাপ হৃদয়বিহীন ওঁচা চায়ের উপরে
কোনও এক সভানেত্রী নেপথ্যে রয়েছে তবু
মেঝের উপরে তার পাদুকার নিরামিষ নিশ্চিত ঘর্ষণে
খানিকটা সিদ্ধ বাঁধাকপি, লেবু, নুন, বার্লি’র থালা নেমে আসে।
পৃথিবীর স্থির কেন্দ্রে ঢের অপার্থিব গবেষণা চলিতেছে-
মক্ষিকার ডানার মতন শব্দ যেন কোনও এক দূর অরণ্যের জ্যোৎস্নারাতে
সম্বিতেরা কুয়াশায় রুষ্ট হয়ে আছে
মাঝে-মাঝে সেগুনকুঞ্জের হাওয়া ভেসে আসে মোমের মতন ঘ্রাণে
মরণের মতো ঘ্রাণে- দু’ চুমুক স্ফটিকের মতো জল খাওয়া যায়-
দু’-একটা বিস্কিট- লেমনেড-
ঢের বই- ঢের চিন্তা গোগ্রাসের মতো মর্মরের,- স্তব্ধ হয়ে আছে।
এক ফুট তৃণগুচ্ছের- হেমন্তের- স্থির- স্থিরতর প্রণিধান ঘিরে
এই বার কোনও এক তিব্বতের লামা- দুর্গত জোব্বার থেকে
রাঙা টোমাটো’র মতো দেখা দেবে
আরাম-কেদারা পেতে আমারে উড়ায়ে দেবে জাদুমন্ত্র ব’লে
মধ্যনিশীথের বিহঙ্গেরা এক বার কোলাহলে জেগে উঠে
আবার ঘুমায়ে পড়ে যখন অপূর্ণ সূচনায়।