মধ্যরাতে ক্লান্ত হয়ে

মধ্যরাতে ক্লান্ত হয়ে- ক্লান্ত হয়ে নিভে গেল মোমের প্রদীপ
ধীরে-ধীরে বোঝা গেল অন্ধকার জীবনের আগে জন্মিয়াছে
যেইখানে জীবনের চিহ্ন কেউ পাবে না ক’ খুঁজে
র’য়ে যাবে;- মেরুর নিশ্চেষ্ট শীতে- জন্ম মৃত্যু মৈথুনের দ্বীপ
চ’লে যাবে সংজ্ঞাহীন হিম ডোডোপাখিদের কাছে
এই সব বৈজ্ঞানিকী;- দু’একটা ডোডো আছে আজও তবু- মোমের আলোকে চোখ বুজে
জল যায় ধীরে-ধীরে;- কারণ এ-পৃথিবীতে স্বচ্ছতোয়া নির্ঝরিণী হতে
যাহা ঝরে- ভালো তাহা;- যে-আলোক আজও নামে নক্ষত্রের থেকে
আজও তাহা অপরূপ- অন্ধকারে- স্তব্ধতায়- রাতের বাতাসে মুখ ঢেকে
মনে হয় বিহার করেছি ঊর্ধ্বে যেন এক বৈমানিক পোতে-

যে-মানুষ জল খায় চির-দিন মৃৎপাত্রে- মদিরার আগে
অন্নরস গাঁজাতে যে ক্ষুব্ধ হয়- দ্রাক্ষালতাদের থেকে অবিরাম রূপ
ছিঁড়ে নিয়ে শ্রান্তিহীন মানবেরা কী ক’রে-যে পিপার আঁধারে
রেখেছে বিবর্ণ ক’রে- এ-বিস্ময় চির-দিন বুকে এসে লাগে
আমারে বরং দাও বল- দাও নক্ষত্র- রাতের হাওয়া- নিবিড় নিশ্চুপ
ইহারা আসুক সব;- স্নিগ্ধ এঞ্জিনের মতো ধীরে- চক্রাকারে
আমারে তুলিয়া নিক আকাশের সব-চেয়ে গভীর বিপথে
ধূসর চশমা: ঢের মননের- রেখে যাক নিচে পৃথিবীতে
উষ্ট্ৰপাখিদের মুণ্ড- বালিগর্ভে- ভুলে যাক সঙ্গে ক’রে নিতে
তারা সব সচেতন হয়ে থাক পৃথিবীর স্ফূর্ত জনমতে।

আরও দুই দণ্ড আমি বেঁচে র’ব, মনে হয়- মরিবার আগে
কী ক’রে-যে বুদ্ধিজীবী মাকড়সা অনুপম ঊর্ণাজাল গড়ে
ডিম পাড়ে- ঈর্ষা করে- ফের গড়ে নিরুপম শিশু-ঊর্ণনাভ
ঢের আমি দেখিয়াছি- বহু-ব্যবহৃত এক কাপড়ের গন্ধে- অনুরাগে
হয়েছি বিক্ষুব্ধ খুব- তাহারে প্রতিভা ব’লে, বস্তু ব’লে তৃপ্ত আড়ম্বরে।
মাটিতে জন্মেছি ব’লে চির-দিন পৃথিবীর ক্লিন্ন রক্তস্রাব
উদঘাটনে ব্যস্ত যদি থাকি কভু- যারা সব ম’রে গিয়ে হয়ে গেছে ভূত
কিংবা যারা জন্মে নাই- কোনও দিন পৃথিবীতে জন্মিবে না আর
সেই সব জিন, পরি, সিলফ আর স্যালামেন্ডারের
অনর্গল রৌপ্য হাসি ছুঁড়ে মেরে মুখে বলিবে যে, ‘কী বিষম অদ্ভুত!’

তাহাদের স্বর আমি শুনিতেছি যেন চারি-দিকে
এই শান্ত বাক্যহীন পাণ্ডুলিপিহীন রজনীতে
আমার মানববুদ্ধি করেছি সকল প্রত্যাহার
কয়েকটা পচা ডিম হাতে নিয়ে সোনার বিচিত্র হাঁসটিকে
ফেরিআলাদের হাতে বার-বার হয়েছে সঁপিতে
সেই সব ধূম্র বাণিজ্যের প্রথা খানিকটা ছিল ক্ষুরধার
অনেক মৃত্তিকা খুঁড়ে ভিত্তি যেন গড়েছিল হৃষ্ট জীবনের
শজারু’র মতো তবু পরিবার দল দেশ আগলায়ে সুড়ঙ্গের স্বাদ
চির-কাল ভালো লাগে না ক’ নির্বিবাদ
তামাশা রয়েছে আজও- আশ্বাস রয়েছে আরও ঢের

যাহারা স্থবির তারা দণ্ডের মতন হাঁটু ভেঙে
অতীতের কথা ভাবে- থুতনি জানুর ‘পরে রেখে
গোধূলিতে বাদুড়ের জমকালো চর্মঘেরা আকাশের পানে
চেয়ে থাকে; খনির আগুনে যেন তাহাদের পীত আত্মা ঝলসায়ে উঠিতেছে রেঙে
নিগূঢ় আমোদ তবু কলরবে জেগে ওঠে নিশীথের বাতাসের ব্যাপ্ত বুক থেকে
পেটের ভিতরে ঢের খড় ভ’রে যেই সব তোতাপাখি মৃত্যুর অজ্ঞানে
ব’সে আছে জাদুঘরে- যে-সব মানুষ, মীন, যে-সব হরিণ
সাঁতার কাটে না আর জলে স্থলে পৃথিবীতে আজ
অন্য এক অধিকারে তারা আজ বিচিত্র সমাজ
অপরূপ অগ্নি খেয়ে উড়িতেছে বাতাসের পুচ্ছে সমাসীন-

আমি প্রেয়সীরে জানায়েছি- বহু দিন গুমোট করেছি অনুভব
সময়েরে সীমাহীন সিন্ধু জেনে- অতীতের মৃত কাননের জলপাই
বুঝে নিয়ে, কবেকার ধুলো ঘাস নাশপাতি সেফটিপিন, বিবর্ণ প্রস্তর
অনেক খুঁজেছি আমি- তার পর অন্ধকারে হয়েছি নীরব
পশ্চাতের শূন্যে চেয়ে- সেতুর চিহ্নও যেন নাই
একটা বিছা’ও ঢোঁক গেলে না ক’ যেইখানে পরিকীর্ণ ছিল সমস্বর
এক দিন;- মাথার অনেক চুল টেনে-টেনে এই সব গৃঢ় বিস্ময়ের
কোনও সূত্র পাই নি ক’ বহু দিন আমি
তার পর চায়ের টেবিলে যেন এক দিন এল এক মিশরের মামি
বলিল আশ্চর্য কথা বিপুল জোব্বার থেকে চুরি ক’রে- ধূর্ত সময়ের।

সেই সব কথা সব মহিলারে তৃপ্তি দেবে হয়তো-বা- তবু জানি না ক’
নারীদের বিমুক্তির দিন আজ- তারা আজ রহস্যের মতো যেন কিছু
ভালোবাসে না ক’ আর- পৃথিবীর ভগ্নজানু নরনারী, গলিত স্থবির,
বহু দিন গুমোটের পরে আমি অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে এক সাঁকো
দেখিয়াছি; কিছু নয় বর্তমান, ভবিষ্যৎ- উঁচু নয় কিছু, নয় নিচু
আমাদের জ্যামিতির ধাঁধার ও-পারে যেন চক্রাকার আভা এক দহিছে নিবিড়
চির-দিন;- সময়ের রুদ্ধ সঙঘারাম থেকে এক দিন চুরি ক’রে মিশরের মামি
এই কথা ব’লে গিয়েছিল এসে আমাদের চায়ের টেবিলে
শুনে তাহা হেসে-হেসে বনিতা ও সন্তানের প্রায় যেন ফেটে গেল পিলে
বুদ্ধি বিবেচনা ঘেঁটে সারা-দিন কল্পনার মনীষারে এক-আধ বার তবু খুঁজে ফিরি আমি।

আরও দুই দণ্ড আমি বেঁচে র’ব, মনে হয়- মরিবার আগে
কী ক’রে-যে বুদ্ধিজীবী মাকড়সা অনুপম ঊর্ণাজাল গড়ে
ডিম পাড়ে- ঈর্ষা করে- ফের গড়ে নিরুপম শিশু-ঊর্ণনাভ
ঢের আমি দেখিয়াছি- বহু-ব্যবহৃত এক কাপড়ের গন্ধে- অনুরাগে
হয়েছি বিমুগ্ধ খুব- তাহারে প্রতিভা ব’লে, বস্তু ব’লে তৃপ্ত আড়ম্বরে।