মহাজিজ্ঞাসা

ছিলাম কোথায় যেন নীলিমার নীচে;
সৃষ্টির মনের কথা সেইখানে আবছায় কবে
প্রথম রচিত হতে চেয়েছিল যেন।
সে ভার বহন ক’রে চ’লে
আজ কাল অনন্ত সময়
সেকেণ্ডে মিনিটে পলে বারবার ক্ষয়
পেয়েছে; তবুও এই সময়ের অহরহ ক্ষমাহীন গতি
থামিয়ে এ-পৃথিবীতে স্থির কিছু এনেছে কি?-
যে স্থিরতা বারবার দিয়ে যায় রাত্রির নিয়তি,
পৃথিবীর দিন যে দাহন দেয়,- সেই সব ছাড়া
আরও বড়ো মানে এক- মহাপ্রাণসাগরের সাড়া?

নিরন্তর বহমান সময়ের থেকে খ’সে গিয়ে
সময়ের জালে আমি জড়িয়ে পড়েছি;
যতদূর যেতে চাই এই পটভূমি ছেড়ে দিয়ে-
চিহ্নিত সাগর ছেড়ে অন্য এক সমুদ্রের পানে
ইতিহাস ছেড়ে দিয়ে ইতিহাসহীনতার দিকে-
মনে হয় এক-আধ কণা জল দিয়ে দ্রুত রক্তনদীটিকে
সচ্ছল অমল জলে পরিণত করতে চেয়েছি।

মানুষের কত দেশ কাল
চিন্তা ব্যথা প্রয়াণের ধূসর হলুদ ফেনা ঘিরে
সংখ্যাহীন শৈবাল জঞ্জাল
সে নদীর আঘাটার জলে
তমসার থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে সময়ের অন্ধ মর্মস্থলে
অন্ধকারে ভাসে।
তবু তারা নীলিমার তপনের অমৃতত্ব বুকের আকাশে
ধ’রে নিতে চেয়েছিল বুঝি;
সাহস সাধনা প্রেম আনন্দের দিক লক্ষ ক’রে
আমরাও সূর্য খুঁজে নিতে গিয়ে গ্রহণের সূর্য কি খুঁজি?

এঁকেবেঁকে প্রজাপতি রৌদ্রে উড়ে যায়-
আলোর সাগর ডানে- আনন্দসমুদ্র তার বাঁয়ে;
মহাশূন্য মাছরাঙা আগুনের মতো এসে জ্বলে;
যেন এই ব্রহ্মাণ্ডের শোকাবহ রক্তে অনলে
মানে খুঁজে পেয়েছে সে অন্তহীন সূর্যের ঋতুর:
জ্ঞানের অগম্য এক অহেতুক উৎসবের সুর
জাগিয়ে বুদ্ধির ধাঁধা দু’-মুহূর্ত দীপ্ত ক’রে পাখি
মানুষকে ফেলে গেল তবু তার চেতনার ভিতরে একাকী।
শূন্যকে শূন্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে শেষে
কোথায় সে চ’লে গেল তবে।

কিছু শীত কিছু বায়ু আবছা কিছু আলোর আঘাতে
ক্ষয় পেয়ে চারি-দিকে শূন্যের হাতে
নীল নিখিলের কেন্দ্রভার
দান ক’রে অন্তর্হিত হ’য়ে যেতে হয়?
শূন্য তবু অন্তহীন শূন্যময়তার রূপ বুঝি;
ইতিহাস অবিরল শূন্যের গ্রাস;
যদি না মানব এসে তিন ফুট জাগতিক কাহিনীতে হৃদয়ের নীলাভ আকাশ
বিছিয়ে অসীম ক’রে রেখে দিয়ে যায়;
অপ্রেমের থেকে প্রেমে- গ্লানি থেকে আলোকের মহাজিজ্ঞাসায়।

আনন্দবাজার পত্রিকা। শারদীয় ১৩৬১