মোমের প্রদীপ জ্বেলে

মোমের প্রদীপ জ্বেলে খাগের কলম নিয়ে বসিলাম
মোম আর কলমের মতন নীরবে
কোনও দূর বৈমানিক নীরবতা জিনে নিয়ে আজ রাতে আমারে করিব অধিকার
যদিও হৃদয় বলে: বরং কবরে যেতে;- পৃথিবীতে রয়েছ তো তেমনই বেকার
(মনে হল) সরীসৃপ-জননীর মতো ঠ্যাঙে- সাদা পেটে- চিৎ হয়ে রয়েছে অলীক
পৃথিবীর সব নদী; আকাশও নদীর মতো-সরীসৃপ-জননীর মতো তারে খোঁচা দিলে তবুও হয় না নৈসর্গিক
আমার হৃদয় যেন ডিং-ডং-ডং-ডং বেজে ওঠে ঘড়ির মতন
বিবর্ণ ঘড়ির মতো উচ্চারিল (অনেক দেখেছি গতি, ব্যবহার, অগ্রসর জ্যামিতিক ক্ষুর ঘর্ষণ
পাকস্থলী কেন্দ্র ক’রে- ঠুলি এঁটে- চাবুকের গৈবি তাড়নায়
কার গাড়ি? কোন দিকে হাওয়া খায়?- কত দূর আরও তারে অগ্রসর ক’রে দেওয়া যায়?
এ-বার থামিতে দাও- ঢের ঘড়ি থেমে গেছে- ঢের হুলো বিড়ালেরা ম’রে গেছে লেজের গোলকধাঁধা নিয়ে
কী হবে সূর্যের পিছে চ’লে-চ’লে সারা-দিন- কাটা খেয়ে- ন্যাড়া গাছে নখ আঁচড়িয়ে
ডিং-ডং ডিং-ডিং ডিং-ডং-ডং

এখন এখানে যদি নেমে পড়ে মেঘের কিংখাব থেকে উর্বশী স্বয়ং
উর্বশী নাই ক’ তবু- সংঘটন চাও যদি- মিনিট পাঁচেক পরে স্টেশনে থামিবে এসে ট্রেন
কোনও দিন আসিবে না ভেবে শান্তি- তবুও হঠাৎ যদি এসে পড়ে বনলতা সেন
আমিও মুখোশ এঁটে ব’সে র’ব- দার্শনিক- চেয়ারে বসিয়া র’বে সে-ও এক সঙ্

প্রেম পুড়ে বিদগ্ধ হয়ে যায়- যায়ই যায়-
দু’-চারটে বই যে পড়েছে সে কি চির-দিন গ্রাম্য রূপসির কোলে তালবৃন্তে হাওয়া খায়
বৈকুণ্ঠে তা হতে পারে- এখানে প্রণয় পুড়ে হয়ে যায় অনুকম্পা- মর্যাদা বরং
তুমি পেঁচা- আমি তত পেঁচা নই- ভালোবাসি: কোথাও রয়েছে যেন সমীচীন আলোকের রং
দুই জনে গোপনীয় মনে ভাবে- ডিং-ডং-ডং

তবুও রাতের ট্রামে এখানে আসিতে পারে অধ্যাপক অবিনাশ পাল
কুমিরের মতো হেসে- যদিও কাটি নি আমি খাল
হেমন্তের পেঁচা আমি- বরং তা; পালায়ে ফিরেছি চির-কাল
ঘুমাব মশারি ফেলে? খানিকটা জল খেয়ে- হয়তো-বা আধখানা কমলার মাংস ক’রে গ্রাস
বাইরে মহিষ না-কী- চামড়ার গাড়ি ছেড়ে এত রাতে- ঘাড়ের ফোড়ায় ভালো লেগেছে এ-রাতের বাতাস?
অবিনাশ ঘরে ঢুকে জানু দু’টো ক’রে নিল ঢিল
কোট হ্যাট পরে না ক’ বহু দিন- ধরেছে রেশমি চাদর সাবলীল!
‘নাও- নাও- তাস নাও’ বলিল সে,
‘বাকি লোক কোথা?’

মুনসেফের দ্বিতীয় পক্ষেরে তুমি দেখেছ কি?
অনেক খাসির মাংস খেয়েছ তো- সেঁকেছ কি মণিপুরি টাট্টুর মেটে
ব’লে গেল অধ্যাপক- দু’-চারটে মিঠে পান জিভ দিয়ে রগড়ায়ে চেটে
পি. আর. এস. অনেক আগের কথা- পেয়েছিল অন্য সব রোমহর্ষ ঘেঁটে
আমাদের বিমলা-যে নাচওয়ালি হয়ে গেল
দাড়িমের ফুল রৌদ্রে- অথবা সে মক্ষিকার ভিড়ে অচ্যুত
শুধাল সে; বুরজোয়া চাটুজ্যে তো ম’রে গেছে- প্ল্যানচেটে বেঁচে আছে ভূত
এ-বার লিখিবে আত্মজীবনী সে- জানায়েছে- ভৌতিক কাগজের পিঠে

দর্শন-বিজ্ঞানহীন আবার সে-আপোশের দিনগুলো- স্যাকারিন- স্যাকারিন-মিঠে
কংগ্রেসের ধামাখানা কাঁচা ডিমে ভ’রে গেল- ভাঙা ডিমে গেল ঘিঁটে-ঘিঁটে
কতগুলো মেয়ে আছে ট্রামে- বাসে- ঘুরিতেছে সমস্তটা দিন
সাদা দাড়িঅলা এক জার্নালিস্ট রোজ রাতে বিছানায় হতেছে নবীন (রঙিন)
কবে যে প্রবীণ হবে- বাস্তবিক- আন্তরিক মহাজন হবে
বক্তৃতার মঞ্চে নয়- প্রবন্ধ প্রসঙ্গে নয়- বিছানার হাঁ-করা নীরবে
‘তবুও সে ভাবনায়- দ্যোতনায়- লোকালয়ে’, বলিলাম, ‘হোক-না রঙিন-
পশ্চিমের মেঘকে কি বলে কেউ তুমি বাপু, মহত্ত্ববিহীন।’
এই সব বুরজোয়া- ডেড এরা- তবু এরা জার্নালিস্ট- পোলিটিক- আমাদের হেড
আমি সোশ্যালিস্ট- চাই লক্ষ-লক্ষ কালো কমরেড
জেবের ভিতর থেকে অবিনাশ বাহির করিল যেন অগণন হাড়গিলে ভূত
বুঁ-বুঁ বুঁ-বুঁ বুঁ-বুঁ শব্দ গুবরেপোকার যেমন-
কবেকার মৃতা নিঃসম্বলা সহধর্মিণীর বিছানায়
মনে হল আমি যেন কাপালিক, আমি অবধূত
লঘিমারে কোলে ক’রে বলিলাম: ‘মণিপুরি টাট্টুর গল্পটা সব-চেয়ে জৈবিক জীব-
এজলাস ভেঙে গেলে মুনসেফ তা হলে তো ভীষণ গরিব!’

‘নাও- নাও- তাস নাও
ছোকরা চাকর দু’টো কই গেল: নাড়ু আর বোথা
ডেকে নাও- তারা যে মানুষ তুমি চিনে নাও- রেখে দাও মনিবি ভড়ং
খিদিরপুরের স্লাম’এ গোরুর কাবাব খেলে মজুরের সাথে ব’সে
মানুষের মানে বোঝা যায় কি রে? খানিকটা অর্বাচীন পলেস্তারা যায় তবু ধ’সে
জীবনেরে চিনে নাও’, বলিল সে তাসগুলি মুড়ে
তাস মুড়ে- তাস মুড়ে- তাস মুড়ে- তবুও আবার তাস মুড়ে
মনে হল নিঝুম এ-শহরের রাত্রির দুপুরে
কারা যেন নামিতেছে মৃত সব হালভাঙা নক্ষত্রের অন্ধকার থেকে
মই বেয়ে মই বেয়ে
সকলের ছাদে
তবু আমি বলিলাম খানিকটা সোনালি আস্বাদে
আমি জানি: জীবনের হরতন রং

আমরা দু’ জনে চলো চ’লে যাই হলুদ নদীর পারে
যেখানে বিষণ্ন গ্যাসে এখন নিবিড় হঙকঙ্-
ব’লে গেল অধ্যাপক তেসে তেসে তেসে
মিস্ত্রি আর মেথরেরা এখানে বসে না কেন এসে
‘চিরিতন’, বলিল সে, ‘কোটি-কোটি চিরিতন-
কোটি-কোটি চিরিতন- জীবনের রং…’
(ডিং-ডং-ডং)

কিছুই হল না তবু- অন্ধকারে চ’লে গেল
রাত্রি- ঘুম- মশারির শূন্যতায়
মাথায় বাঁদরটুপি দুইটি বামন যেন মুর্গির মতো ঠ্যাঙে ছুটে-ছুটে খেলে পিং-পং
ডিং-ডং ডিং-ডং-ডং