মৃণালিনীদের কথা মনে পড়ে

মৃণালিনীদের কথা বিকেলের কুয়াশায় মনে পড়ে আজ
জীবনে বৃষ্টির দিন সমধিক রয়ে গেছে ব’লে
পরিষ্কার হেমন্তের মাঠ পেলে- তার স্বামী অবনি পালিত
বিবর্ণ কোদাল- কাস্তে- হাতে নিয়ে নিজেদের ছোট
আতুর প্রাঙ্গণ ঘিরে বহু ক্ষণ নিড়োবার কাজ
ক’রে যেত- প্রত্যহ বিকেলবেলা- পৃথিবীর অপর রকম
কাজের ব্যর্থতা থেকে ফিরে এসে- মিষ্টি আলু, শালগম, মুলো
যে-সব অদ্ভুত ফল ক্বচিৎ আকাশে সূর্য দেখে
জ্ঞানময় পেচকের মতো যারা পৃথিবীর নাড়ি
চিনে নেয়- কবলিত করে- স্থির শান্ত পরিহাসে
পেঁচা’র মুখের মতো ফুটে ওঠে আঁধার কোটরে
তাহাদের অকাতর মাংস পেয়ে এরা দুই জন
তবুও ক্বচিৎ জ্ঞান আহরিত করেছিল পৃথিবীর পথে
ঢের দিন বেঁচে থেকে- নিরীহ ঘুঘুর মতো চোখে
সর্ষের ফুল- ভিটে- ভিটের ঘুঘুর দিকে চেয়ে।

পঁচিশ বছর আগে মৃণালিনী পৃথিবীর থেকে
মোড়কের সমাশ্রয়হীন সাদা কর্পূরের মতো
মিশে গেছে- বস্তুতই উপরের আলোর ভিতরে
এ-সব ব্যাধির থেকে ফেঁসে গিয়ে ম্লান সমুদ্রের
ভিতরে স্বাধীন রোগে- জানি আমি- প্রবাল-কীটের
শরীরে সে আজ আলো- সমীচীন নিসর্গের পথে
চেয়ে দেখ- রূপসির রুগ্নতাও সময়ের ঘড়িদের কাজে
লেগে যায়। আমিও স্থবিরতর হয়ে এই পৃথিবীতে বেঁচে
মাঝে-মাঝে হেমন্তের ইশারায় নগরীর ট্রেন থেকে নেমে
এ-সব প্রান্তরে আসি- মেয়েটির সমাধির ‘পরে
চেয়ে দেখি এখনও একটি ইট ছাড়া কিছু নেই
মার্টিনের কন্ট্রাক্টর এ-রকম- তবুও কী ক’রে আজও ইট
বেঁচে আছে- পাথরের মতো কালো- পরিমেয়- বিচক্ষণ হয়ে
তবুও অপরিমেয়- একটি কুকুর-শোঁকা দ্রোণ-গাছ- উলুখড়, শর
তাহার নিকটে নেই- মাথার উপরে
অতীব অন্যায় ভাবে দীর্ঘ হরিতকী
সহসা জন্মাতে গিয়ে স’রে গেছে- সমস্ত আকাশ
বিশেষত স্বাতী আর সরমাকে ইটের চোখের পথে রেখে

এখনও অবনি তবু বেঁচে থেকে ঢের বেশি বুড়ো
হয়ে গিয়ে- তবুও- আবার এত বুড়ো হয়ে গেছে
যাতে এই পৃথিবীর বৃদ্ধতার নিরূপণে সে এখন জীব
নয় আর- বাংলার এই সব ঢালু সমতল
পাহাড়বিহীন দেশে কখনও সে হেমন্তের রুগ্ন বিকেলের
অতিরিক্ত অন্যায় আলোকের কাছে ধরা প’ড়ে
কোনও-কোনও মানুষের হৃদয়ের কাছে
সহসা পাহাড়ে-পথে ব’সে আছে- যেন- মনে হয়
দুম্বা-ভেড়ার মতো; কপালে নিরীহ দু’টো শিং
রয়ে গেছে; অনেক অদ্ভুত মাংস এখনও জঘনে
লেগে আছে- এই সব অবান্তর প্রসঙ্গের কথা ভেবে তবু
মানুষকে অবিচার করা হয়-
কেননা অবনি ঢের সহৃদয় নারী, কাজ বড়ো নগরীর
ঠিকাদারি পেয়েছিল- তবু সে হাওয়ার গায়ে জীবনের নাম
লিখে দিয়ে- একটি লণ্ঠন জ্বেলে জীবনের জাপানি লণ্ঠন
জ্বেলেছিল মনে ক’রে জীবনের জাপানি লণ্ঠন
নিভায়েছে- তাহার হৃদয়ে কোনও প্রেম- কোনও স্পষ্ট আকাঙ্ক্ষার
উদ্বেল সততা নাই- বস্তুত তাহার প্রাণ হিম কার্তিকের
নক্ষত্রের স্পর্শে এসে আমাদেরই নাগরিক হৃদয়ের মতো
প্রতিহত হয়ে চুপে কারু কাছে প্রতিশ্রুতিহীন
প্রাঙ্গণের খেতে তার ক্ষুদ্রতর কৃষকের কাজ
একাকী সমাপ্ত করে- সূর্য আর নক্ষত্রকে সাময়িক ঘড়ির মতন
সমস্ত প্রকাণ্ড উঁচু আকাশের সাধারণ সমতল পথে
বিশেষ বীটের থেকে আবিষ্কার ক’রে নিয়ে রোজ
এখানে ইটের কাছে আসে জীব
উবু হয়ে ব’সে থেকে বহু ক্ষণ নিড়োবার কাজ
ক’রে যায়- এইখানে পরিচিত পরিমেয় ইটের ভিতরে
অন্য কিছু নেই তাই- অমেয় সততা লেগে আছে।