নিকটে গাছের ডাল

নিকটে গাছের ডাল অন্তঃসত্ত্বা হয়ে আছে শিশিরের জলে
শীর্ণ উঁচু ঝাউগুলো চ’লে গেছে নদীর ভিতরে
নিজেদের অধিক বিবর্ণ স্থির বিম্ব ভালোবেসে
তবুও কোথাও পূত প্রণয়ের কথা নেই আজ
পবিত্র সংশয় এক কুপিত রক্তের মতো মানুষের মনে
থেমে আছে- যে-মানুষ চিন্তা ক’রে গেছে- ভাবে
কখনও সে চিন্তা করে নাই
আমরা কী নিয়ে বীজ- মনোবীজ বুনে যাব- আকাঙ্ক্ষায়
অথবা আমরা কোন স্থিরতর অনুভাবনাকে
আমাদের হৃদয়ের পথে পাব স্ফটিকের বর্ণময় চতুর ফৌজের মতো
সে-সব সুস্থতা আজ প্রভাতের নিসর্গেও নেই।
আমার পায়ের কাছে অসংখ্য উদ্ভিদ মুখ যেন
মৃত পিতৃপুরুষের মতো চোখ মেলে
চোখ বুজে হেঁট হয়ে থেমে থাকে
ছড়ির প্রহারে আমি তাহাদের জঙ্ঘামুণ্ড ছিঁড়ে
ফেলে দিয়ে যাই যদি- তা হলে তাদের
নেপথ্যের থেকে কোনও অনুযোগ নেই
মৃত বেদনার সাথে আমাদের সবার ব্যথার
এই এক সেতু আজ
শুধু এই নির্জন প্রণয় রয়ে গেছে
নদীর আড়ালে প’ড়ে দুই দূর তীর থেকে আজ
মৃত আর জীবিতেরা এই কথা জানে।

সমস্ত জন্তুর রোল মানুষ ও উদ্ভিদের মতো আজ
কী এক মায়িক রূপান্তর যেন হয়ে গেছে আলোর ভিতরে
পরস্পরের বন্ধু সকলেই জানি- তবু- কোনও এক ধীমান দানব
আমাদের সকলের প্রাণে অগ্নি জ্বেলে দিয়ে গিয়ে
আমাদের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে গেছে তবু এই
যেন কোনও এক প্রাণী অন্য কোনও জীবনের হাওয়ার ভিতরে এসে
বিয়োগ, বেদনা, পাপ, প্রণয়ের রূপকগুলোকে
বিষয়ের মতো পায়-
বিষয়গুলোকে খায় অবিকল রূপকের মতো বোধ ক’রে
সমস্ত পৃথিবী তাই অকৃত্রিম ভয়, প্রেম, সন্দেহের ভরে
আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে
আমিও তাদের দিকে চেয়ে আছি- অনুরূপ সুরের মতন।

।।
আমিও সবের মত সৃষ্ট হয়ে এসেছি এ-পৃথিবীতে
প্রথমে ক্ষুধার তরে- তার পর- প্রণয় ও শ্রদ্ধার, বিস্ময়ের তরে
মাঝে-মাঝে মনে হয় তুলাদণ্ডে বাসনার চেয়ে যেন কিছু বেশি দামি
বিস্ময়, সততা, প্রেম
অথবা লালসা যেন অন্ধকারে ওতপ্রোত হয়ে
একাকার হয়ে ক্রমে মিশে যায় সকলের সাথে
সকলকে বুনে নেয় নিজের নিয়মে
পৃথুর জন্মের থেকে আজ এই মুহূর্ত অবধি
এ এক দুরন্ত শিশু- কখনও আদৃত হয়ে গেছে ঢের বেশি
যেন এক মোটা কৃষকের খেতে উর্বর ইয়াঙ্কিস্থানে
বার্বাঙ্কের হাতে প’ড়ে ফুলে গেছে শালগম
অধিক সময় তবু অধিক জীবনে আধি-অবজ্ঞায়
নিপীড়িত হয়ে এক ধূর্ত শীর্ণ বামনের মতো
ঢের পরমায়ু পেয়ে তবুও নদীর জলে মুখ
কখনও সে দেখে নাই- অনেক বেদনা পেয়ে তবু
সময়ের সিংহদ্বারে এসে তার পিঙ্গল লাঙুল
দেখে গেছে- কখনও সিংহের মুখ তবু
অনুভব করে নাই

সর্বদা ব্যাহত হয়ে তবু তার গতির ভিতরে
কোথাও শুশ্রূষা নেই- সর্বদাই অজর, অক্ষর
শিশুর মতন ঘোরে ব্রহ্মার অন্তকে ক্লান্ত ক’রে
তবু এই অপোগণ্ড রূপান্তরিত হয় যদি
এই ভেবে মনীষীরা ভিন্ন-ভিন্ন কালের ফোকরে
চিন্তা ক’রে চ’লে গেছে- আমাদেরও সবের হৃদয়ে
এই অনুভাবনাই সব-চেয়ে প্রথম- প্রধান
কী ক’রে উদর, জিব, লিঙ্গ নিজ স্থির কেন্দ্র পেয়ে
কী ক’রে কালের লিঙ্গ সুস্থতায় শিষ্ট হতে পেরে
মানুষকে ব্যাস দেবে- অন্য সব বিস্ময়ের তরে
নিজের গ্রাসের চেয়ে তবুও দুরূহ কালসাপ
নিজেকে উন্মীল ক’রে নিতে গিয়ে তার চেয়ে গভীর বেদনা
উদ্গীরিত ক’রে যায়- সব-চেয়ে গাঢ়তম বিষ।
এখন অনেক দিন পরে সেই সময় এসেছে।

।।।
এখানে বাতাবিলেবু গোল- ভারি হয়ে ওঠে ভোরের আলোয়
মেহগিনিদের কালো শাখাগুলো তিনটি সোনালি চিল নিয়ে
পরিতৃপ্ত বিবেকের স্থিরতায় যেন এক দর্পণের মতো।
জীবন ও মৃত্যুর অন্তরালে- কোনও এক অন্য বুদবুদের।
নিজেদের রেখা কেটে দিকে-দিকে চ’লে গেছে পথ
বিষুবরেখার কোল ঘেঁষে ক্রমে দূরে-দূরে গিয়ে তুচ্ছ হয়ে
অবশেষে সময়ের আধারে পড়েছে-
চিলগুলো উড়ে গেল- গম্ভীর রন্ধ্রের থেকে ফ্যাক্টরির ধোঁয়া
আমাদের সন্দিহান, ক্লীব, ভীরু হৃদয়কে তবে
নিজের জিনিস ভেবে আবার দখল ক’রে নিয়েছে নীরবে
রাত্রির গহ্বর থেকে উঠে এসে এক ভিড় মানুষ ওখানে
সূর্যের আলোর নিচে দাঁড়ায়েছে একা
একা হাঁটে- কথা ভাবে- কাজ করে
রগড়ে আসক্ত হয়ে পুনরায় নিজের ফাঁদলে
নেমে এসে নির্দিষ্ট একাকী কথা ভাবে
আমারও হৃদয় এই ভারি অকৃত্রিম
অকাতর দ্রাঘিমার পৃথিবীতে সৃষ্ট হয়েছিল
নানা রূপ ক্ষুধা নিয়ে- বিনয় ও বিস্ময়ের তরে
রাক্ষুসে নৃত্যের মাঝে তাই আমি- তবু-
ক্বচিৎ স্থিরতা চাই- তবু চাই- স্থিরতাকে চাই-
যেন চক্ষু উৎপাটিত হয়ে কোনও ভিষকের যন্ত্রের ‘পরে
স্থির থাকে- পুনরায় পূর্ণতর শুদ্ধ হয়ে নিজের খোঁড়লে ফিরে গিয়ে
স্থির থাকে- অনেক অপূর্ব বিড়াল রয়ে গেছে
অশরীরী বায়ুর ভিতর থেকে নেমে আসে যেন
ভিষককে ফাঁকি দেয়- প্রবীণ রুগিকে
প্রতারিত ক’রে যায়- মানুষের চৌরস চোখ
মাছের শল্কের মতো খেয়ে ফেলে স্বতঃসিদ্ধতায়
সেই সব বিড়ালের নির্দোষ নিবিড় ক্ষুধা আজ
চারি-দিকে আমিষের ঘ্রাণে ঘোরে
তাহাদের সংখ্যা আজ ব্রহ্মা’র আয়ুর মতো অগণন
বায়ুর ভিতরে আমি নিরাবিল মুখ
ন্যূব্জ ক’রে রেখে দিলে তাদের অধর
আমার প্রান্তরপ্রিয় ঘোড়াদের মতন দাঁতে লাগে
আমার নিসর্গগামী বর্তুলের মতো খুর তাদের হৃদয়ে
ব্যথা দেয়- অন্ধকারে গ্রন্থ, চিন্তা, নক্ষত্র, প্রেমের
নিরুদ্দেশ লক্ষ ক’রে হেঁটে গেলে তাদের নখর
আমার কুসংসর্গ ছিঁড়ে ফেলে। তবুও নীরব
স্থির চোখে চাই আমি- কেননা সুস্থির চোখ থেকে
আয়ত শৃঙ্খলা এসে জন্ম নেবে- যেখানে সকলই দোষ
অথবা উদর, লিঙ্গ, ভীষণ নির্দোষ উত্তেজনা।