নিরাশ হোয়ো না

নিরাশ হোয়ো না
জীবন তোমার সিদ্ধার্থের মতো হ’ল না
কিম্বা সলোমনের মতো হ’ল না
কিম্বা ওমরের মতো হ’ল না
এই ভেবে হতাশ হবার মতো কিছু নেই
আমি জানি
আজকের ভোরের এই রোদ- সবুজ ঘাস- শিশির
সিদ্ধার্থের মোক্ষের চেয়ে যশের চেয়ে আমার কাছে ঢের দামি।

সলোমনের হারেম এখন মৃত
কিন্তু তুমি উনিশ শো ঊনত্রিশের মেয়েমানুষ বেঁচে রয়েছ
আরও অনেক দিন থাকবে
অনেক বিস্ময়ের রোমহর্ষ জাগিয়ে
ওমরের কবিতা আজ ডি-লুক্স এডিশনের জাদুঘরের ভিতর চ’লে গেছে
ওমরের হাড় জিওলজির স্তরের ভিতর
কিন্তু আমার কবিতা এখনও
পাবলিশারের স্পেকুলেশনের জিনিস মাত্র নয়
আমার হৃদয়ের নিত্যনতুন চমক- আবেগ- আবিষ্কার
আমি বেঁচে রয়েছি
তুমি বেঁচে রয়েছ
জিওলজি আমাদের ঢের পিছে
আমার কবিতার ডি-লুক্স এডিশন যখন বেরুবে
তখন আমার হাড় জিওলজির প্রয়োজনীয় স্তরের ভিতর চ’লে গেছে
আমি সিদ্ধার্থের মতো হয়ে গেছি
সলোমনের মতো হয়ে গেছি
ওমরের মতো হয়ে গেছি
এই সব নাম শুধু;- নাম- নাম- নাম
আজকের ভোরের চড়ুইয়ের কাছেও তার
ঘাস রোদ শিশিরের দাম
কি এ-সবের চেয়ে বেশি না?
চড়ুই প্রতি মুহূর্তেই রোদের থেকে রোদে লাফাচ্ছে
পচা হাড় প’চে যাচ্ছে শুধু!
কবি: জীবনানন্দ দাশ

[সিদ্ধার্থ: সিদ্ধার্থ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত সমাস, সিদ্ধ (অর্জন) + অর্থ (সম্পদ/ জ্ঞান) = সিদ্ধার্থ (অর্জিত জ্ঞান)। অর্থাৎ কোন যাত্রী (অনুষন্ধিৎসু ব্যক্তি বিশেষ) যিনি তার মোক্ষম লক্ষ্যে পৌছুতে সক্ষম হন। বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বে গৌতম বুদ্ধের নাম ছিল রাজপূত্র “সিদ্ধার্থ গৌতম”। তার জন্ম আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অথবা ৪৮০ অব্দ লুম্বিনী, শাক্য গণরাজ্যে আর মৃত্যু আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অথবা ৪০০ অব্দ (৮০ বছর) কুশীনগর, মল্ল গণরাজ্যে। তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর অন্তিম বাণী ছিল “সকল জাগতিক বস্তুর বিনাশ আছে। অধ্যবসায়ের সাথে আপনার মুক্তির জন্য সংগ্রাম কর।”

সলোমন: শব্দটার হিব্রু অর্থ শান্তির মানুষ। হিব্রুদের রাজা (খ্রি. পূ. ৯৭২-৩২)। পিতা ডেভিড। তাঁর রাজত্বের ভালো দিকগুলো: ব্যবসাবাণিজ্যের রমরমা, শান্তি, স্থাপত্যশিল্পের প্রভূত উন্নতি (যথা, জেরুজালেমের মন্দির); খারাপ দিকগুলো: দারুণ খরচাপাতি করে জাঁকজমকের বাতিক, প্রজাদের ঘাড় ভেঙে কর আদায়, উপজাতীয়দের বিদ্রোহ। বাইবেলের অনেকগুলি বইয়ের জনক বলা হয় তাঁকে; সলোমনের গীত, পুরোহিতদর্পণ, নীতিবাক্য, জ্ঞানী উপদেশাবলি, ইত্যাদি। সলোমনের ভক্তিগীতি বলে চালু যেসব গান, সেগুলিকে অবশ্য ভেজাল বলেছেন কেউ কেউ। কিংবদন্তী বলে, খুবই জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি ছিলেন তিনি, বিয়েও করেছিলেন অনেকগুলি, হারেম বানিয়ে ফেলেছিলেন একটা।

ওমর: ওমর খয়্যাম (খ্রি. ১০৫০-১১২৩)। পারস্যদেশীয় কবি এবং গাণিতিক। ইসলামীয় দিনপঞ্জী বানিয়ে তুলতে তাঁর জ্যোতির্বিদ্যা খুব কাজে লেগেছিল, ঠিক কথা; কিন্তু তাঁর রুবাই তাঁকে বিখ্যাত করে রেখেছে, এবং তার জন্যই তাকে আমরা মনে রাখি প্রধানত। তাঁর পাঁচশো-র বেশি চৌপদী বা রুবাই। ঈশ্বরে অবিশ্বাস, বেদনাবিধুরতা ও সুরা- সাকি- সঙ্গীতের জন্য কামনা- বাসনা- লিপ্সায় এমন শারীরিকতাময় হয়ে আছে যে, তাঁর উচ্চমার্গের জ্ঞানগম্যির কথাটা আর আমাদের মনে পড়ে না সচরাচর।]