নিরীহ, ক্লান্ত ও মর্মান্বেষীদের গান

আমরা বিশেষ কিছুই চাই না এবার।
আমাদের অন্ধকার আলো
এনেছে অনেক কিছু অবিশেষ, অকিঞ্চিৎকর।
এমন অনেক দিন কেটেছে এমনভাবে,- তবে
আবার অনেক দিন তবুও কাটাতে চাই এ-রকমই।
হেমন্তে আশ্চর্য শাঁস ফ’লে গেছে কালো জলে, পানিফলে, ঝাউয়ের ভিতরে;
অথবা ফলে নি কিছু;
ভাসুর পীড়িত হয়ে অতএব ভাদ্রবৌকে দেখে বকে;
চোখ মেলে, চোখ বুজে দেখেছি অনেকবার সে-রকম রুগ্ন দুর্ভিক্ষকে;
সন্ধ্যায় ঠাণ্ডা খুব বেড়ে গেলে অবশেষে ঘরে
চ’লে গেছি;- হেমন্তের নীরবতা এ-রকমভাবে
আবার আসুক তবু;-
আকাশের নক্ষত্রেরা যেমন নিরীহভাবে ঘুরে যায়
বিচ্ছেদ, মরণ, ভয় কলের চাকার মতো তেমনই ঘুরাবে
আমাদের সকলকে- আমাদের সকলকে নিয়ে;
তেমনই নীরবে;
সাদাসিদে ভাবে।
আমরা জলুস, জোর, কুকুর বা সিংহের সুরে
বাধা পাই;
পেঁচা যে খড়ের চালে নেমে আসে পৌষের রাত্রির দুপুরে
সেই সুরে শান্তি আছে- শেষ আছে- মৃত্যু আছে জানি,
তবু সেই সুর ভালো।
উনিশ’শ তিরিশ থেকে উনিশ’শ চল্লিশ সাল তবু ভালো ছিল;
আজ একচল্লিশে পৌষ মাসে কেমন অসাধ যেন।
মশা মেরে, ধান ভেনে, ইঁদুর তাড়িয়ে
মহাজনদের কাছে ঋণ নিয়ে- ঋণ খেয়ে- ঋণ ভুলে গিয়ে,
হাতুড়ের কাছে গিয়ে শিশিরের মতো সাদা শিশি-
যা সবের কাছে যা নেবার আছে- নিয়ে যাব;
যা সবের কাছে যা দেবার আছে দিয়ে যাব;
ক্রমাগত পায়ে হেঁটে আমাদের সন্তান ও সন্তানের সন্তানকে পৃথিবী হাঁটাব।
সন্ধ্যায় ঠাণ্ডা খুব বেড়ে গেলে হত্তেল ঘুঘুদের ঘরে
অথবা ভিটেয় যে গুণোপেত একটি বা দু’টো ঘুঘু চরে-
সেইখানে অসংসর্গ অনুভব ক’রে যাব;- হেমন্তের নীরবতা এ-রকমভাবে
আবার আসুক তবু।
আকাশের নক্ষত্রেরা যেমন নিরীহভাবে ঘুরে যায়-
বিচ্ছেদ, মরণ, ভয় কলের চাকার মতো তেমন ঘুরাবে
আমাদের সকলকে- আমাদের সকলকে নিয়ে।


এখানে বিশেষ কিছু হয় নি অনেক দিন।
ক্রমাগত মানুষের মরণ হয়েছে।
গরিব, বেচারা, বুড়ো, বিকলাঙ্গ, মহৎ পার্ষদ সব
কী ক’রে কেবলই খ’সে ধুলোসাৎ হয়ে যায়
দেখেছি উদাস, ক্লান্ত- অন্তরঙ্গভাবে;
দেখে-দেখে ঘুরে ফিরে অন্ধকারে বিকল হতাম,-
যদি না রাত্রির শেষে ভোর, সূর্য, সময়ের পরিস্রুত হাত
মুছে ফেলে দিয়ে যেত সব।
এই সব ছাড়া
এখানে বিশেষ কিছু হয় নি অনেক দিন।
সমুদ্রের বুদবুদের মতো অগণন সমুচ্ছ্বাস
তেমনই প্রবল কিছু চেয়ে গেছে,- পেয়ে গেছে?- রাতে
ফিরেছে বিবিক্তভাবে সুত মিত রমণীর সমাজ জুড়াতে;
ফেরে নি কি?
আমরাও ঘুরে গেছি; আমাদের হৃদয়ের রুচি
আমাদের জীবনের উতরোল অপপ্রতিভাকে
ঘাইহরিণীর মতো যে-রকম সৃষ্টির জ্যোৎস্নায়
যেমন সহিষ্ণুভাবে ডেকে গেছে,
যেমন নিবিড়ভাবে ডাকে-
সেই সুরে সাড়া দিয়ে।
কখনও নদীর জলে অদলবদল ক’রে ভেসে গেছে মেঘ, রাজহাঁস;
পুনরিপ মেঘগুলো- জলগুলো- আশ্বিনের মাস;
ডুবে গিয়েছিল সব,- নেই ব’লে মনে হয়েছিল:
সুরের ছোঁয়াচে সুর যে-রকম হয়ে যেতে চায় অর্থহীনভাবে অনুপ্রাস।
কখনও ধানের খেতে ধান নেই।
কখনও ধানের খেতে কৃষাণের হাসি কোলাহল;
গোলায়-গোলায় গঞ্জে ইঁদুরের বৌকাঁটকীর মতো কলরব;
বন্দর বেতার তার টের পায় সব।
কখনও পাটের খেত লকলক ক’রে ওঠে বাসুকির মতো;
আল-কেউটেরা সব কৃষককে কাটে ইতস্তত;
কখনও পাটের জমি চিত্রগুপ্ত বুঝে নিয়ে গেছে;
একটি মূলেও কোনও ভুল নেই, আহা।
তবুও চড়কপূজা, ভাদুপূজা- কত না গাজন গান এল গেল;
কত চাঁদ বড়ো হয়ে চালার পেছনে রাতে তারপর ছোট হয়ে এল;
গৃহস্থ, কৃষাণ মিলে ধোঁয়াটে জলের শ্যাম পানফল-
পোষলার পিঠে আর মিঠে তাড়ি খেল।
এ-সব উৎসব তবু মৃত ইতিহাস;
এ-সব উৎসব কিছু নয়।
সর্বদা উৎকণ্ঠা এক জেগে আছে সকল ঘনায়মান পার্বণের মাঝে,
মৃত্যুর উদ্বেগ ছেপে- আরও বেশি কূট;
যে যার নিজের স্থানে উঠে চ’লে ব’সে
কেবলই জীবন যৌন, নিরাশা, রিরংসা, অর্থ, দশ কথা ভেবে
তবুও একটি কথা ভাবে তারপর
নিজের মনের মুদ্রাদোষে।
প্রৌঢ়েরা এখন আরও বুড়ো,
যুবকেরা প্রৌঢ় হয়ে গেছে,
বালকেরা এখন যুবক,
নারীর দেশের থেকে ঢের নারী হারায়ে যেতেছে;
সকলই ভৃত্যের দেশ।
এই সব স্বাভাবিক- সাধারণ কথা;
এখন মানুষ তবু স্বাভাবিকভাবে কথা ভেবে নিতে গিয়ে
কোথায় পেয়েছে সফলতা?
আজ এই চতুঃসীমানার মুখে আমাদের প্রাণে যদি আত্মপ্রত্যয় থেকে থাকে
ঘাইহরিণীর মতো জীবনের হরিণকে তবে সে জ্যোৎস্নার পানে-
প্রেতজ্যোৎস্নার পানে ডাকে।
ডাকে না কি?
নিতান্তই কোনও কিছু ভয়াবহ ভয় যদি আমাদের দিকে
ক্রমে-ক্রমে চ’লে আসে আজ,
তবুও তা ভয় ব’লে মনে হতে দেরি-
যত দিন দেরি হয়- তত দিন ভালো।
আমরা সকালবেলা পেয়ে গেছি সূর্যের আলো,
আমরা রাত্রিবেলা পেয়ে গেছি বাতি;
গণেশ যে-সব কূট শ্লোক নিয়ে একদিন বিবেচনা ক’রে গিয়েছিল,
সহজ স্ফূর্তির মতো সে-সব তোমার প্রাণে জন্মেছিল, ব্যাস,
স্বভাব-সুখের মতো রাত্রির ফুটপাতে একদিন অগণন গ্যাস
জ্বলেছিল- মনে হয়েছিল;-
আমরা সকলে
যে যার নিবিষ্ট জন্ম, প্রসন্নতা, মরণের কাজে
অজানিতে ঘুরে গেছি; কথা
ব’লে-ব’লে হয়রান মলিন জনতা
হয়ে গেছি;
কেউ তবু হাড়ে-হাড়ে আমাদের অল্পপ্রাণতাকে
চিনে জেনে নিতে গিয়ে ব্যথিত করে নি।
কী এক সম্পূর্ণ ঈর্ষা কেবলই নিকটে নেমে আসে তবু আজ;
কখনও ধানের খেতে- কখনও নদীর ভুয়ো জলে
নিরন্ন বছর নামে;-
বর্গাদার- মহাজন- প্রজার মহলে
হুলুস্থূল প’ড়ে যায়;
এখানে ভাগচাষ- শহরের হুণ্ডি- ঠিকাদার
ভূশণ্ডির মাঠ- ঘাঁটি- বারভূঞাদের ভূত- ব্যবচ্ছেদাগার- শব-
হাতুড়ে ডাক্তার-
ফিসফিস ষড়যন্ত্র- রাস্তার কানাচ-
এই সব সূর্যের চেয়েও বেশি বালুকার আঁচ;
এরা সব হুলুস্থূল ক’রে যায়।
কোনও কোনও প্রৌঢ় এসে অত্যাচার করে;
অগণন যুবকের ভিড়ে কোনও কাজ নেই,- চিন্তার কুশল র’য়ে গেছে;
চারিদিকে সর্বগ্রাসী দরিদ্রতা;
জনমানবের মুখে নিজ নিজ শোকাবহ গোপনীয় কথা;
নিজেরই ঘরের জন্যে ঘরন্তী শক্তির নির্মমতা;
মূর্খ দেশ, মেয়ে দেশ, প্রভু দেশ, ভৃত্য দেশ, পাগলের দেশ রয়ে গেছে,
রয়েছে বালির দেশ;
দার্শনিকদের দ্বিধা- মনীষীর হৃদয়ের প্রেম
সে-সব বালির ‘পরে দাগ কেটে অন্তহীন স্বপ্নসৌধ গড়ে;
হৃদয়বিহীনভাবে ধূর্ত সমুদ্রের কাছে,
প্লোভারের, পায়রার বিষ্ঠার ভিতরে।
সবেরই স্বতন্ত্র বেদনা র’য়ে গেছে।
এক বেদনার মাইল-মাইল জুড়ে তিল
ধারণের স্থান আছে- আছে কিনা অপর ব্যথার?
আমাদের সকলের বেদনা কি মিলেমিশে যেতে চেয়েছিল-
অথবা যে যার প্রাণে চেয়েছে কি- পেয়েছে কি ভীষণ স্বাধীন অন্ধকার?
দেখি না- জানি না- তবু অনুভব ক’রে কোনও সূর্যালোকে অতিমৃত্যু পেলে
পুনরায় ঊষালোক হয়তো-বা জীবনে পেতাম;
আমরা পেতাম না কি?
তবুও অনেক ঊষা এসে গেছে ইতিহাসে,- ঊষা সব নয়;
জনসাধারণ ভাবে আজ আমাদের একাকী হৃদয়
অনেক জেনেছে,- তবু অমেয় বিপ্লব শুরু শেষ হয়ে গেলে
রুটিনের সৌন্দর্য ও আত্মপ্রত্যয়
মানবজাতির কাছ থেকে চেয়ে নিখিলের মানবেরা পাবে;
না হলে মানুষ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও সন্দেহের দিব্যতায় কোথায় দাঁড়াবে।