নগরীর এক টেরে দুর্গ

মনে হয় নগরীর এক টেরে সেই এক দুর্গের কথা
অনেক বছর আগে সেইখানে মানুষেরা তরবার ব্যবহার করেছিল
সেই সব স্মৃতি তবু আজ আর আরশোলাদের নীড়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে না ক’
কোনও শ্রেষ্ঠী সেই দুর্গ কিনে নিয়েছিল তার পর
(তখন শান্তির দিন নেমেছিল পৃথিবীতে
শ্রাবণের আঁধার আকাশে খানিকটা উত্তুঙ্গ রৌদ্রের মতো
স্মিত- অবিশ্বাসী)- তার পর সে-প্রাসাদ চ’লে গেল
কোনও এক মনীষীর হাতে-
করতলে দূরবিন তুলে করিত সে আকাশের- নক্ষত্রের আলোচনা
জমকালো জোব্বা প’রে টেবিলে বসিত খেতে
কাশ্মীরের যত ফল- মান্দ্রাজের সমুদ্রের মাছ- আর গৌড়-বাংলার
প্রান্তরের আশে-পাশে যেই সব জলপায়রার ডাক শোনা যায়
যে-সব অরণ্যমুর্গি শেয়ালের কান্নায় চমকায়ে মধ্যরাতে
আবার চাঁদের দিকে চেয়ে সব ভয়- ব্যথা-
শিকার উপরে তুলে রেখে- মানবের মতো আত্মা পেয়ে
শৈবালে ঘুমায় ঠেসে- দর্শনের স্বপ্ন দেখে-
তাহাদের সকলের মাংস খেয়ে- জলপাই, আমলকী, মরিচ, আরক
অনেক ধূসর তেল- সুমিষ্ট ঘাসের রস- জল-
সচ্ছল- স্ফটিক-স্বচ্ছ পাত্র থেকে ঢেলে
যকৃতকে শান্তি দিত। ধুলোর মতন সে-ও
উড়ে গেল এক দিন; নিচ্ছিদ্র দেয়ালে
সর্ষেবীজের মতো জন্ম হল ফাটলের,
তার ফাঁক দিয়ে তার মানবিক অনুতাপ (কেন, আহা!)
চ’লে গেল সূচের মতন যেন চৌম্বিক
ঝাপসা সুতার টানে- হয়তো-বা হয়েছে সে ফাল
এত দিনে;- চরিতেছে জ্যোৎস্নায় শেয়ালের মতো;

ফরসেপ টেনে নিয়ে- হয়তো-বা- নিষ্কম্প অব্যর্থ হাতে
প্রসব করায়- হয়তো-বা চাখড়ির কাঠি হাতে তুলে
মৃত্তিকার মেঝের উপর গোসাপের ছবি আঁকে
সমস্ত কাঙরা লজ্জা পেত সেই সব আকীর্ণ প্রতিভা দেখে

হয়তো-বা আরও গাঢ়; হাতে পেয়ে জমাট বর্তুল
এক জন অঙ্গারকে মনে করে আমলকী- অবিনাশ
কোনও এক নিরুদ্দিষ্ট- দীর্ঘ- দীর্ঘতম তরুর পল্লব থেকে
দুলিতেছে যেন;- কিংবা তার সব-চেয়ে শ্রেষ্ঠ পরিণতি:
আদি-কারণের শ্লেষ্মাসিক্ত নাসিকার মতো মাঝে-মাঝে
হেঁচে ওঠে: যুবকেরা ফুটপাথে গিরিবর্ত্মে টার্পিনগাছের ছায়ায়
সময়ের-ঘড়িহীন মণিবন্ধ হিম ক’রে লক্ষ-লক্ষ স্তব্ধ শশকের মতো
পৃথিবীর সাথে গোল হয়ে গোল হয়ে ঘুরিতেছে তাই
শান্তি, শান্তি!- ইঁদুর-ধূসর জলের তনিমা চলিতেছে আধাসিদ্ধ
উষ্ণ কেটলির পরিখাকে নদী ব’লে অস্বীকার ক’রে
কোনও লাভ নেই- লাভ নেই জেনে

সেই দুর্গ সৃষ্ট হয়েছিল কবেকার ভয়ঙ্কর শিলা দিয়ে
সে-সব পাথর কারা তুলেছিল- পেয়েছিল সেই সব মেধ
সেই মূঢ় মৃত শতাব্দীর বিশীর্ণ আঙুল যেন স্বর্ণগোধিকার
মেধাবী আঁখির মতো হৃদয়ের জাদুঘর থেকে
উঁকি দেয়- কী এক বিতর্ক যেন প্রসূত হতেছে তাই
অনেক জড়িত ফাঁসে লিপ্ত হয়ে স্বপ্ন বিবেচনা যেন
মুহূর্তে-মুহূর্তে এক কঠিনতা লাভ ক’রে: জীবনের সফল বিচিন্তা
আঁকড়ায়ে- আঁট ক’রে ধ’রে- কোনও দেবতাত্মা অশ্বত্থের (মতো)
(শিকড়ের মতো) এক দিন মৃত্তিকার ডানার বাতাসে
ধুলোর মতন সব উড়ে যাবে,- অগ্নির মতন তবু।

সেই দুর্গে তার পর যেন মোর পরিচিত
(তখন আমার হাত অলস ছিল না এই আকাশে বাতাসে
আজও যেন নিরলস মনোবাহু ঘুরিতেছে- পৃথিবীতে
সমুদ্রের পারে শ্বেত কাঁকড়ার দ্বীপ: মানবআত্মার কাছে
ধরা প’ড়ে যেই রূপ পায় তেমন সচ্ছল দ্বন্দ্বিতা নিয়ে)
দু’-তিনটি লোক স্থান পেয়েছিল; সোমনাথ ছিল
অনেক সন্দর্ভ নিয়ে তবু দুরারোহ প্রচারের দিকে
ছিল না ক’ মন তার- ক’ জনার থাকে?- বরং সে সারা-দিন
কোথাও নদীর পারে গিয়ে- কোনও এক অব্যবহৃত বোধ:
মানুষের শব্দতত্ত্ব যার কাছে ভ্রূণ শুধু
সেই সব অল্পভাষী নিভৃত জলের শব্দে
হৃদয়ের খাদ্য পেত; কোনও বেওয়ারিশ তরণীর ভিজে কাঠ
মাঝের নদীতে ঘুরিতেছে- আবিষ্কৃত হত তার চোখে
বিম্বও দেখি নি কোনও দিন তবুও সেখানে মোরা
(আমাদের চোখ থেকে প্রতিভা হরণ ক’রে নিয়ে গেছে
হয়তো-বা কেউ- অথবা আমরা চাঁদনির চক থেকে
ঠুলি কিনে নিসর্গের চোখে পরায়েছি- ভালোবেসে
তাহারে এ-জীবনের কুলোর বাতাস ব’লে বোধ ক’রে
সমস্ত অসার তুষ কুনো ইঁদুরের মুখে
ছড়ায়ে উড়ায়ে দিয়ে-)

মাঝিরাও কূল পায় নাই- সারা-দিন ভিজে মেঘে
ছেঁড়া-ছেঁড়া বাতাসের মুঠোগুলো কোনও দূর
অপার্থিব যুবাদের মুষ্টির মতন অনুভব ক’রে
সোমনাথ সেই সব মৃতদের আরও প্রিয়তর খোঁজে
প্রান্তরের দিকে চ’লে যেত;- আমরাও-
নিকটের পাখির ডানার চূর্ণ ধূসর আলোয়
পাড়াগাঁর মেঠো কাননগু’র ঘোড়াটিকে
গ্রন্থিল বাতাস খুলে ধীরে-ধীরে হেঁটে যেতে দেখে
দাঁড়কাক পরিত্যক্ত নারকোলমালা ঠোকরায়, টের পেয়ে
ছাগলের হাঁচি শুনে- কোনও দূর মণ্ডপের ঢেউয়ে
অজস্র মানুষ সমিতিতে এক-সাথে কলরব করিতেছে
(তালব্য শ’এর মতো যেন সেই ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
বাতাসের জিহ্বাকে মেঘের তালুর দিকে
ঠেলে দেয় বার-বার?)- এই প্রশ্ন নিয়ে বহু ক্ষণ অবহিত হয়ে- ব’সে থেকে
মাথার উপর দিয়ে কতগুলো অতিকায় চিংড়ির কাটলেট যেন
এক পাল এরোপ্লেন উড়ে গেলে;- কিন্তু সব-চেয়ে-
সোমনাথ প্রান্তরের দিকে চ’লে গেছে ব’লে-
অন্য এক নির্ঘণ্টের পরিচয় অনুভব করিতাম
কোনও এক লুক্কায়িত জীবনের;- তবু সোমনাথ
(ছিল না ক’) হাস্যরসহীন এক অমানব- বনমানুষের হাড়;
(ছিল না ক’;)- হোগলা’র খেতে বাবুইপাখিরা নীড় গড়ে
বাসা বুনিবার স্বাদের ও-পারে বড়ো বাবুইয়ের মতো
কী রয়েছে- আধােঅন্ধকারে ব্যাজিলিস্ক যেন
তোমার চোখের দিকে চেয়ে- কিংবা আরও গূঢ় কুয়াশায়
হয়তো-বা জ্যৈষ্ঠের দুপুরের জ্বলন্ত আলোয় দোয়াতের কালি,
কাচের গেলাসে জল, কোন স্বাদ- কোন শেষ সত্য স্বাদ
আনিতেছে;- এই সব জানিবার হঠকার- তার জীবনের
দন্তরুচিকৌমুদীকে- কবরের অন্ধকারে গিলে রেখেছিল (বহু দিন)
ঘোর তামাশায় তবু মাঝে-মাঝে উঠিত ফেনায়ে
কোনও এক অতিধনী অভিমানী মদ্যপকে
সুরানিবারণী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ক’রে
সম্পাদক হয়েছিল সোমনাথ দু’-এক চুমুক
প্রসন্নতা আহরণ করিবার সময় এসেছে জেনে
টাকাকড়ি নেই কিছু- গুমর রয়েছে-
কসাইয়ের হাতে ন্যস্ত অভিমানী গাভী’র মতন
এই দুই অবিনাশী জীবনের হলুদ সৈনিক
সকালে ঠকাত নিজেদের;- রাত্রির ফুরোনো প্রহরে
ঢের দূর- আধােসন্দিহান- শুঁড়ির দোকানে ঢুকে
প্রতিষ্ঠাতা তবু মদের গেলাস তুলে মুখের নিকটে
টেবিলের ‘পরে রেখে দিত- সাধু কয়েদির মতো,
হঠাৎ পিছন থেকে সোমনাথ দোকানে ঢুকেছে দেখে
ক্লান্তিহীন গবলিন, বেদান্তের জটিলতা মনে ক’রে তাকে
পরস্পর আবার প্রতিজ্ঞাপত্ৰ বেঁধে দিত অবশেষে:
এই সব আদিরস অনাদির আদিমের তরে
আমরা অনাদি নই- আমরা আদিম নই- ম্যাস্টোডন নই-
আমরা অনাদি নই- আমরা আদিম নই- ভ্রাম্যমাণ ইহুদির মতো
নই আর; যেই সব ডোডোপাখি ম’রে গেছে
তাহাদের আত্মা ভ্রান্ত: জোনাকির যোনির মতন;
পরিষ্কার প্রণালী রয়েছে প’ড়ে- জীবনের
ঢের বই লেখা হয়- ঢের বই আলোচিত হয়
আমরা মশা’র মতো পিছনের জলে র’ব না ক’ আর
আজ এই পৃথিবীর গ্যাস-আলোকে- জনরবে-
সূর্যমন্দিরের থেকে ব্যক্ত শ্বেতদন্তে- হাস্যরোলে রজনীর ঘুমে
আলপিন-শীর্ষ থেকে আলপিন-শীর্ষে নেচে
মশা’র আর উর্বশী’র কোনও লাভ নেই
তবু তারা দুই জন শুধু এই আর দু’টো রাত
কয়েকটা স্কচ আর ফরাসীয় ছিপি খুলে-
দানবীয় সুদৃঢ়তা দিয়ে যেত সঙ্কল্পকে
মনের ধবল অহঙ্কারে হেসে (চৌধুরি-সাহেব) চেক কেটে দিয়ে
সোমনাথ ঘোষালের নামে আরও ঢের ভবিষ্যৎ
বোতল উৎসর্গ ক’রে। কঞ্চির ঠেঙোর ‘পরে
দু’টো দৈত্য যেন;- গোরু’র-গাড়ির নিচে চাপা প’ড়ে
পাঁচ টাকা ফাইন দিয়ে ম’রে গেছে এক জন
আর-এক জন অপার্থিব লূতার পিছনে ভেসে
শ্লথ তন্তু হয়ে গেল- হেগেল’কে ধ’রে- মদ ছেড়ে-

পরশপাথর যারা অন্বেষণ করেছিল পৃথিবীর মধ্যযুগে
কিংবা যারা খুঁজেছিল কোনও হাড়- কোনও গ্রন্থি
মানুষের দেহের ভিতর অনাদৃত বেকারের মতো কোথাও লুকায়ে রয়েছে
এক দিন তার ইন্দ্রজাল ধরা দিলে সব ধুলো সোনা হয়ে যাবে
মরণের সাথে এক পয়ঃপ্রণালীর সেচে র’বে না মানুষ আর
এই সব অনুভব ক’রে- নীলাম্বর দত্ত ছিল তাহাদের
হৃদয়ের সহোদর- যদিও সে বামার-লরি’তে
কলমের কাজ চালাত সমস্ত দিন- কোনও এক ধূসর-ধূসর মডেলের
মোটর গাড়িতে চেপে যেন এক প্রণয়িনী আরিয়াডনি’র পরিব্যাপ্ত সুতো ধ’রে
নগরীর ট্র্যাফিককে নিরেট নির্জন চোখে অবহেলা করিবার
প্রাঞ্জল প্রতিভা ছিল তার; একটি হাতুড়ি নিয়ে ‘সাদাআলা পিলাগ’এর সাথে
অভেদাত্মা হয়ে যেত;- ব্রহ্মরাক্ষসের মতো আলিশান মোটরের
সমস্ত অন্ত্রের কথা (যদিও বিবর্ণ মডেলের)- সমস্ত আত্মার পরিচয়
নখাগ্রে সে বিঁধে রেখেছিল- সভ্য ছিল বরফের সমিতির
উচ্চতর সিগারেট বানাবার কল চাই বাঙালির
পঞ্চাশ বছর আগে সন্দিহান মন তার উচ্চৈঃস্বরে বলেছিল
সেই সব আশ্চর্য দিনের বার্ডসাই ফুঁকে-জলরঙ্ এঁকে
(সেই সব দিন কই আজ- ভিক্টোরিয়া ছিল মহারানি)
তবুও সে ঢের মানুষের চিংড়ি’র-দাঁড়ায় বিক্ষত
পুণ্যজলে স্নানার্থীর যেন-মাংসহীন-কাঠের-পায়ের মতো
স্থির এক মানদণ্ড নিয়ে অন্য এক প্রিয় নিষ্ক্রমণে
তার জীবনের বড়ো বিচিন্তাকে ব্যবহার ক’রে গেছে
অফিসের থেকে রোজ রাতে ফিরে এলে
মৃৎকার্পাসের মতো হৃদয়ের দুশ্চর নিরেট গর্ভে একটুও
অগ্নির আঁচড় রাখিত না;- এলোকেশি চৌখুপ্পি ভিজে তোয়ালের
আরামে পাগড়ি বেঁধে কালো ছাগলের এক-জোড়া ঠ্যাঙের মতন
শীর্ণ মোজা নিয়ে রিফু ক’রে যেত ন্যাবার মতন পীত আলো জ্বেলে
তালি দিত সূতির চাদরে, বোতাম লাগাত কোটে
যেন আমাদের সকলের প্রপিতামহীর মতো- আমরা ঘুমোলে জেগে থাকে
কাপাসতুলোর মতো সাদা বাতাসের বেগে চরকায়
সারা-রাত সান্ত্বনার সঙ্ঘারাম বুনিতেছে যেন তার মোম
যেখানে যা ভয় আছে- খেদ আছে- অবিশ্বাস আছে
মানুষের জীবনে যে-অর্ধচেতন শেয়ালের শিশুগুলো
রাত্রির বামাচারী জননীকে প্রান্তরের ও-পারে হারিয়ে
গর্তের ভিতরে কেঁপে ওঠে- তাহাদের সবের শিয়রে
ধাত্রীর মতন যেন জেগে আছে পীতাম্বর- তার মুখ; মোম;
কৃষ্ণদাস কবিরাজ কী লিখেছে- জানে না সে- হয়তো-বা নামও শোনে নাই
কবিরাজ গোস্বামীর;- অমৃতের হ্যাংলা পিপাসা তার দেখে নাই
গাঢ় রাতে তার মোম-
আর তার পক্ষীতত্ত্ব বাদামি ফরমাগুলো
(কবে-যে সে কত পাখি দেখেছিল!)- আমাদের কাছে
আমলকী-মোরব্বা’র মতো মনে হত- আধােঘুমে, প্লূত অনিদ্রায়
মাঝে-মাঝে প্রকাণ্ড দুর্গম রাতে অনেক বায়ুর শব্দ শুনে
আমাদের ঘুম ভেঙে যেত;- হ্রস্ব দানবেরা তবে ছুটে যায়
মৃত পুরাতন চায়ের পেয়ালা ছাতা প্ল্যানচেট মাকড়সা মেঘ নিয়ে?

আকাশের নিঃসহায় চুনাপাথরের স্তম্ভ থেকে
আমাদের দিনের আলোয় পরিচিত শেষ বোন- হৃদয়ের বোন
শতভিষা- অনুরাধা- শুকতারাদের-
শুষ্ক শামুকের মতো ঝেড়ে ফেলে মালয়ের নাবিকের মতো
সেই সব অন্ধকার বোঝা নিয়ে চ’লে যায়
ধীরে বিছানার থেকে উঠে দেখিতাম (নীলাম্বর)
ভোরের সমুদ্রপারে বিদেশিনি রূপসির
কমলারঙের গোল ছাতার মতন এক
জ্যোতির আমোদে ব’সে পক্ষীতত্ত্ব লিখিতেছে
অনেক আশ্চর্য পাখি হৃদয়কে অধিকার ক’রে ফেলে
তবু দূরে উড়ে চ’লে গেছে তারা বহু দিন, লোষ্ট্র হয়ে গেছে
পৃথিবীর রাস্তা যারা মেরামত করিতেছে দিন-রাত
সেই সব অভিমানহীন মুক্ত মনীষার হাতে

ফিলজফি দু’ চোখের বিষ ছিল সমীর বোসের
মানুষের জীবনকে সমুদ্রের মতো মনে ক’রে
কোনও শ্লথ পুরুভূজ বিছানায় শুয়ে
লক্ষ তরঙ্গের শব্দ- পরস্পরবিরুদ্ধ জ্যামিতি ল’য়ে
তাহার গণিতবোধ দেয়ালা করিতে এসে ম’রে গেছে
বরং সে দেখিয়াছে অতিকায় কাঁচপাত্রে জলের বিঘোর
কে যেন ঢালিতে আছে দিন-রাত
ঝরনার মতো উপচায়ে পড়ে কোনও নীচ অন্ধকারে
কিম্বা শীর্ণ সলিতার মতো জিভ তুলে
দূর শূন্যে উবে যায় ভারতীয় মায়াবীর দড়ির মতন
কে-বা জানে;- কাঁচের বৈয়মে- মাঝপথে
লাল নীল মাছগুলো স্ফটিকের মতো বিম্ব গিলে
খেলা করে;- কোথাও রয়েছে এক প্রবর বণিক
(হয়তো-বা)- গভীর প্রাসাদে তার কক্ষে-কক্ষে কী বিষয় আছে
(সেই জানে) খানিক- খানিক করুণা তবু
রয়েছে নিজের তার- (পোষা মৎস্যদের তরে)
আরাধনা আছে- হয়তো-বা এরা তার ম্যাসকট
মাঝে-মাঝে শুধু কলিজায় অম্ল জমে তার
অথবা যকৃৎ যেন ধােপার গাধার পিঠে চ’ড়ে
আরও সাদা- দুগ্ধসাদা হয়ে ফিরে আসে
বণিকের কাছে;- তখন বৈয়মে নির্জলা দ্বাদশী
একাদশী?- নিরম্বুর আত্মা পান ক’রে
অপ্রীতির জন্ম হয়;- গ্যাস জমে- দহমাণ লাক্ষাগৃহে
পীড়িত মাছের আত্মা দর্শনের ক্বাথ পান করে
প্লেটো- পতঞ্জলি- নিম্বার্ক- হেগেল’এর জন্ম হয়-

তবু আরও ভয়ঙ্কর পরিণাম আসে
উদাসীন নিপীড়িত বণিকের চিকিৎসক
নাড়ি টিপে ঘুমের আরক দিয়ে তারে
মুখ টিপে হেসে- টিপ-টো’এ চ’লে যায় ধীরে
কপাটটা খুলে নিষ্ক্রান্ত হবার আগে পিছু চেয়ে
দু’টো গোল বড়ো চোখে পেচকের মতো উল্লাসে
তার পর মিশে যায় বাহিরের বিহ্বল আঁধারে
সেই ক্লিষ্ট নিদ্রা থেকে দুঃস্বপ্নের অঢেল লণ্ঠন
নেচে ওঠে- কালো ধলা বিড়ালের ঝগড়ার বাত্যা নামে
মস্তিষ্কের কীর্ণ গর্ভে;- সেই সব ছবি- অন্ধকার- ধ্বনি- প্রতিধ্বনি
আমাদের কাঁচের পাত্রের চারি-পাশে
গোল হয়ে গোল হয়ে ঘুরে যায় বাইসনের ক্ষুরঘর্ষণের মতো
সুন্দর- ভীষণ- বুদ্ধর মূর্তির পিছে
ক্লান্ত নির্বাণের থেকে নেমে এল নেউলেরা
আকাশকে মৎস্যের গামলার মতো গ্রাস ক’রে
মৃত্যু, মেধ, মৈথুনের মহান বিক্ষোভে
আমাদের পরিচিত শৃঙ্খলাকে প্রতিবাদ ক’রে
বিশৃঙ্খলা জীবনের প্রিমিয়াম মোবিলের মতো?
কে-বা জানে- মানবিক দর্শনের ক্বাথ: শুধু ক্বাথ!

তবুও সমীর বোস দার্শনিক- হয়তো-বা কবি
একটি বেলের কাঁটা দিয়ে তবু তার ফানুসকে
প্রয়োজন আছে কী-না ফুঁড়িবার- শুধাব না
চিত্রবর্ণময় বিত্ত কবিতার ইন্দ্রধনু, তবু
সাজবার মতো ছিল না ক’ তার জীবনের
ধুসর জিনের স্যুট প’রে- স্টেথোস্কোপ হাতে নিয়ে
বার হয়ে যেত- লবেজান শেষ জাহাজের মতো
হয়তো-বা নিকট-সমুদ্রে এক- পাহাড়ের শিঙে
কিংবা এক অলম্বুস শকুনের ডানার আঘাতে
চূর্ণ হয়ে যাবে তার অতিব্যবহৃত জীবন-প্রয়োগ
যখন অসিত ফিরে হামিদের একচোখো ন্যাড়া ঘোড়াটার মতো
আবার গভীর রাতে- (মনে হত) গৃহস্থের হাতে ছোলা খেয়ে
হাড়গিলা কোনও উঁচু প্যাগোডা’র কুয়াশায় নীড়
বাঁধে না ক’ আর- (মনে হত) স্মিত মুখে কর্নিশের দিকে চেয়ে
ঠিক ঘড়ি-ধরা কোয়ার্টার-কাল রহিতাম ব’সে
সে-ও মুখোমুখি ব’সে আছে;- আরবের রকপাখিদের
একান্ত ডিমের মতো বড়ো সাদা ল্যাম্প
ডিনারের মেহগনি টেবিলের ‘পরে
যদি জ্ব’লে যেত- ভালো হত অত বড়ো দুর্গের ভিত্তিতে
সেই বাতি ছাড়া কি জ্বলিবে আবার
কিন্তু তবু মাঠের পেঁচা’র মতো মেটে চিমনির
লণ্ঠন জ্বলিত এক কাঁঠালের কাঠের টেবিলে
আমাদের দু’জনের জীবনের দ্বিদল নদীর ফাঁকে
ত্রিকোণ বালুর চর বেছে নিয়ে
মহারাজ ত্রিশঙ্কু’র মতো যেন স্বাদে

আজও সে ত্রিশঙ্কু না-কী? মাটি থেকে দূর নীলিমার
প্রকাণ্ড প্রসারটারে চির-দিন খানিকটা দ্বিধায় দেখেছে
তবুও সময় এল ওতপ্রোত স্টেথোস্কোপ’টাকে
পৃথিবীর নোনাধরা দেয়ালের পাশে ফেলে রেখে
জরিপের ফিতে হাতে নিয়ে
বাদুড়ের মতো সসম্ভ্রমে উড়ে যেতে হবে
নির্বান্ধব ডানা ল’য়ে: কঙ্কাল-কঞ্চির
পৃথিবীর সব-শেষ দ্বীপ- দূর চাঁদের শিঙের পরপারে-
যেই পথ হতে সাহসী জননী তিন্তিড়িও
মাথা নেড়ে স’রে যায়- পল্লবের বাছাধনদের
পেটের থলিতে পুরে- ক্যাঙারু’র মতো
পৃথিবীর প্রান্তরের বিনিয়োগে-
তিসি’র বীজের মতো মিশে যায়;-
পিছে ফেলে; তবু আরও কিছু পরিমাপ করিবার তরে
সাপুড়ের ডানার মতন তার কোটের পকেট থেকে
সেই স্টেথোস্কোপ-সরীসৃপটাকে আধোমুক্তি দিয়ে
তার পোষা নাম ধ’রে ডেকে তাকে
আধেক নিমগ্ন রেখে যেন কোন বিষদাঁত-ভাঙা ঝিমে
জীবনের জাদুকর সাজিতে পারে নি তবু
জীবনকে ভালোবাসে যারা পথে নেমে একেবারে
পরিহাসকের কাছে গিয়ে তাহাদের কিছু কর দিতে হয়:
হয়তো-বা কানাকড়ি; জিনের পিরান তার
একটা পেরেক টেনে আমার এ-দেয়ালের ‘পরে
কবে-যে সে ঠুকে দিয়ে গিয়েছিল
এক রাশ মাকড়ের জালে- বাহিরের ভিজে হাওয়া
মুলো’র মতন বড়ো ধূসর দাঁতের বাতি ধ’রে
কোটটার স্পাইনাল-কর্ড খুঁজে মাথা খুঁড়ে পড়িতেছে
আমার টেবিলে এক স্থির আলো- তবু বুঝি না ক’
নরকের উদ্বর্তন থেকে উঠে ডাইনিরা
প্রান্তরের পথ দিয়ে উড়ে যেতে-যেতে
প্রিয় এক পরিচিত ইয়ারের ঘ্রাণ পেয়ে
ভিজে মুর্গিকে সেই অতি-অতিব্যবহৃত
আরামের শখ- ব্যথা- ডিম্বপ্রসবের ব্যথা দিতে
আঁধারকে ক’রে দিল বনমোরগের নখরের মতো?-
কিম্বা নিলামের সব-শেষ চড়া দাম দিয়ে
(তোমারে স্মরণ করি বলরাম মল্লিকের নিষ্পলক প্রেত)
ক্লান্ত ন্যূব্জ জামাটাকে কিনে নিয়ে গেল না-কি
কফির পেয়ালা-হাতে বয়ঃসন্ধিদীর্ঘ এক আর্মানি গণিকা
চুরুটের ধোঁয়াভরা অমরার চাঁদনি’র চকে।