অনেক গম্ভীর মেঘে

অনেক গম্ভীর মেঘে যখন আকাশ গেছে ভ’রে
বিকেলের রৌদ্রে আজ মনে পড়ে- দেশ এক
যার নাম চক্রটক- যেখানে মৃতেরা থাকে হয়তো-বা-
আমাদের পৃথিবীর আপামর আনন্দকে নিয়ন্ত্রিত করে
নীহারিকাস্তম্ভিত স্তব্ধতার বিভীষিকা দিয়ে
যখন হৃদয় শূন্য- পালকের মতো লঘু
উড়ে যেতে চায় কোনও তিরোহিত সমুদ্রের
সৈকতে পাখির মতো পৃথিবীর পীঠ দেখে শেষ এক বার
হিরেকষসমুজ্জ্বল দূর রৌদ্রে- ইতিহাসহীনতায়
এই সব মেঘ যেন ম্যাজিনো লাইনের মতো জেগে থাকে
এমন নিশ্চল- উঁচু- সুনিবদ্ধ- দৃঢ়-
আমাদের নব-নব উত্তেজনা ধন্যাত্মক দেশে
এত প্রতিধ্বনিহীন। আমাদের অজস্র ভাবনাবীজ
অন্তরঙ্গ শেলফ-ভরা পুস্তকের রাশি
যেন ঢের কলরবসমাকুল- আর কিছু নয়
শুধু ঘুরে-ফিরে রোটারি-প্রেসের সন্তান।
ঐ সব মেঘবিদেশের মুণ্ড- মনে হয়
আমার ব্যক্তির দিকে চেয়ে আছে- বহু ক্ষণ
যেন কোনও নগণ্য দর্পণও তুলে নিলে
টের পাব কেমন সুডৌল আত্মরতি।

তাহাদের কোনও আত্মক্রীড়া নাই
কেন্দ্রীয় ধারণা সব শত বিবেকের
এই সব সিংহাসনে সমারূঢ় বৈকালিক দিগন্তের হিম মেঘ
কোথাও চৈনিক পর্বত থেকে- কলকাতা-
মুদ্রারাক্ষসের মতো গম্বুজের বন্দরের পর
প্রবেশ করিতে আছে কোনও ক্লান্ত কুকুরের
উদাসীন উচ্ছিষ্ট চোখের ওই তৃতীয়-নেত্রীয় ঝলকে
কোনও-কোনও মানুষের স্নায়ুর দর্পণে
কাহারা তা হলে মেঘ- এই সব মেঘ-

বহু দিন পুরানো আবেগ যেন দুর্গ ছিল
যা পেয়েছি মধ্যরাতে প্যারাফিন-আলোর নিকটে
গ্রীক দর্শনের থেকে এক দিন- সেই ভাণ্ড নিয়ে
সূর্যের সোনায় রুষ্ট বীজাণুর মতো রোম নিষেবণ ক’রে
মনে হত আমিও সম্রাট যেন ময়ূর-আসনে
সময় লুণ্ঠন ক’রে অবহিত আড়ম্বরে
জ্যোতির্ময় শৃঙ্খলায় নিয়োজিত করেছি আমারে
আমার মেঝের ‘পরে ধীমান সৈনিক সব
ঘুমায়ে রয়েছে স্ফুট নক্ষত্রের আলো খেয়ে রাতে
তবু তারা জেগে ওঠে সকলের আগে- ভোরে
নিটোল আরিস্টটোল, প্লেটো, ফ্রিনিকাস

বহু দিন আগে তবু এক দিন
মধ্যন্দিন সমুদ্রের পরে
মনে হল সেই সব মনোবীজ শিল্প যেন
আইকেরাসের মতো ডুবে গেল ঝিকমিক অগ্নির ভিতরে
উদাত্ত জলের নিচে- অপহৃত প্রেমের প্রতীক।
ভারতীয় উপনিষদের দিন তার পর:
তা-ও প্রেম- আমার হৃদয়ে মূল গেঁথেছিল এক দিন।
বৃহত্তর প্রতিবেশীদের রীতি- তবু- মনে হয়-

মহত্তর;- তাহারা বন্টন চায় যদি
আমরা নিকৃষ্ট দান দিয়ে দিই
উড়ানি খইয়ের মতো আমিও অনেক ছেঁড়া পাতা
উড়ায়ে দিলাম সেই আকর্ষণী বাতাসের দিকে
যেমন বিমর্ষ মুষা সকালের সোনালি সূর্যকে
বাসমতী ধান খেতে ছেড়ে দেয় কৃষকের হাতে
বিবর্ণ গহ্বরে ঢুকে পরিচর্যা চায়- পায়-
বহুতর অত্যাশ্চর্য দিগদর্শনীর
সুড়ঙ্গের অন্ধকারে বিশ্রুত সমাজ গড়ে- ভাঙে-
মনে হয়- আমাদের রাষ্ট্র- তবু- তার পর
পিতৃলোকদের ঘনকৃষ্ণ পাথরের সাজের মতন নয় শুধু
আমরা মূষিক নই- মক্ষিকাও আমাদের চেয়ে ঢের নিসর্গের মতো
সূর্যেরই কেন্দ্রের থেকে তেজস্ক্রিয় যেন।
আমাদের প্রতিকূল পরিমাণ পৃথিবীর দেশে এসে।
প্রমিতি পেয়েছি ব’লে। নিয়ে যেতে হবে সব দীর্ঘ দিন বিরুদ্ধ সমীরে।

এইখানে রাত্রির গ্যাসের আলোয় ইতস্তত
নৃমুণ্ডের কলরব;- ছায়াছবি ব’লে ধরা যায়
হঠাৎ বিমুখ ভাবে হেসে যদি মনে করি
নেগেটিভ প্লেট সব- অপেক্ষায় প’ড়ে আছে
কোনও এক বিলোল শিল্পীর উদাসীন
অন্ধকার প্রকোষ্ঠের ধুলো বালি বায়ুহীনতায়
কয়েকটা অস্পষ্ট গাছের ছায়া এইখানে
কোনও এক দূর নিরক্ষর সমুদ্রের থেকে
বাতাস আসিছে ভেসে ফাল্গুনের রাতে
আমাদের স্পর্শ ক’রে- তবুও চেনে না আমাদের।
এইখানে- ঐখানে দু’-চারটি কৃকলাস যুবা
রাত্রি-ফোকরের দিকে রয়েছে তাকায়ে
যেন তারা মৃতবৎসা। জরায়ু রয়েছে তাহাদের,
জানি আমি- তবু কোনও ফলসাই ডিম নাই।

ঐ দিকে শহরের কেন্দ্রযন্ত্র মাইলের-পর-মাইল অস্থির রেখেছে
চলিতেছে চোখ বেঁধে বৃহত্তর নিরুপায় দ্বীপে।
এইখানে সদ্যঃপাতী বিম্ব সব খেলা করে চীনেলণ্ঠনের মতো
অনেক বিষাক্ত মাংস কামানের চেয়ে সরু চিক্কণ হিংসায়
বৃশ্চিকের ছিবড়ের মতো ফেঁড়ে রয়েছে বিছায়ে
ঘড়ি-ধরা একটি ঘণ্টা ব’সে পারম্পর্য স্তূপ করা যায়
কোথাও ঘড়ির কাঁটা ছাড়া কোনও বিষয়ের উর্বর প্রতীক
মাইলের-পর-মাইল ভূমিখণ্ডে কোনও দিকে নাই।
আকাশের সপ্ত-ঋষি- বৃহস্পতি- অনুরাধা- তারা
অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, কৃতবর্মাদের কটিদেশে
সূত্র বেঁধে- রেখেছে রাত্রির হাতে- নিবিড় শপথ।