অভিভাষণ

আমার মৃত্যুর পরে তারা যদি বলে:
(আমার ভাষায় নয়- সেই সব কমরেডদের মুখের ভাষায়ই আমি বলছি):
“বাংলা’র পল্লীচিত্র তিনি ভারি সুন্দর এঁকেছিলেন
বাংলা’র প্রকৃতিকে তিনি যেমন দেখেছিলেন
‘পোস্টমাস্টার’এর ছবিটুকু কী সুন্দর কী গভীর
মধ্যবিত্তের বউ কমলা’র গল্প প’ড়ে চোখের-জল না ফেলে পারা যায় না
হরিদাস মান্না, অনন্ত দাসঘোষ, শ্রীদাম সামন্ত- আরও অনেক
চাষাভুসো কলু’দের সম্বন্ধে তার গল্প-কবিতা
তাঁকে মানব-স্রোতের ভিতর বাঙালির ঘরে-ঘরে
আমাদের তুচ্ছতম ভাইবোনদের অন্তরের কবি ক’রে রেখেছে
মহান তাঁর প্রতিভা- তার চেয়েও বড় দরদ
গভীর ধর্মবোধ- জনসাধারণের প্রাণের স্পন্দন-
মহামানবের বিশাল হাট- গণদেবতার মহান সংহিতা-
জাতীয় দুর্গতির জীবন-দেবতা
এমন হবে না কোনও দিন-”

তা হলে মৃত্তিকার নীচে আমার তুহিন অনুভূতি
অস্বস্তিতে গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে
তাকিয়ে দেখবে নানা দিকের সাহিত্যসভায় আমার সম্বন্ধে এমন আলোচনা শেষ ক’রে
তারা অমৃতি খাচ্ছে- বাঁশি বাজাচ্ছে- আতর, পান, চুরুটে সুবর্ণসিংহ’র মতন হাসছে
কয়েকটি বালিকার নাচের ব্যবস্থা- ইনকামট্যাক্স-ইনসিওরেন্সের সাদর ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসা
ডলি ও মিলি’দের সাথে ভালোবাসার প্রথম ও শেষ কেচ্ছা: সবই রয়েছে
হয়তো একটা রোলস-রয়েস নেই-

আমার মৃত্যুর পর যেন তারা বলে: ”কৈ, তার নাম তো শুনি নি কোনও দিন
কী লিখেছিল?- কী হিজিবিজি লিখেছিল?-
তার কোনও অর্থ বোঝা যায় না- কোনও মানে হয় না
জাতির অন্তরকে আঘাত করে না
ছোট মেজো ভাইবোন গলাগলি হয়ে মিলে-মিশে
তার কবিতার ভিতর সেই চণ্ডীদাস থেকে শুরু ক’রে রবীন্দ্রনাথ অব্দি
আমাদের প্রাণের দেব-বাদের মতন কিছুই পাই না-
কিছুই নেই;
যেমন, ‘শুন হে মানুষ-ভাই’- কিংবা ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’-
যা লক্ষ বার আবৃত্তি করলেও ফুরায় না- যা নিয়ে দশ জনে মিলে
কাঁদতে- হাসতে- বা, কলরব করতে না পারি
সে-সব জিনিস কি কিছু?
মৃত্তিকার নীচে আমার আত্মা বলবে: না- কিছু নয়-
সে-সব জিনিস কিছু নয়।

আমি পৃথিবী থেকে চ’লে গিয়েছি ব’লে
যদি কোনও অঘ্রানের বিকেলে একটা বিশাল আকাশ-চিল
মৃত্তিকার তরঙ্গের দিকে নামতে-নামতে তার বন্ধুকে খুঁজে-খুঁজে ঘুরে-ঘুরে অবসন্ন হয়ে
একটা অশ্বত্থ-গাছের নীড়ে বিদীর্ণ হয়ে ঘুমিয়ে থাকে
যদি রানার মেইল নিয়ে অন্ধকারে দৌড়তে-দৌড়তে কী এক কথা ভেবে
খানিকটা মৃত বাতাসের প্রয়োজন বোধ করে
যদি আব্দুল গোরুকে জাবনা দিতে গিয়ে বার-বার মাটির উপরেই ফেলে দেয় সব
গোরুটির তির্যক চোখের প্রশ্নে কেঁপে ওঠে যদি সাদা দাড়ির সবুজ মানুষটি
যদি কয়েকটি শিশু ও নারী শুকনো পাতার ভিতর সাপের শব্দ শুনে
তবুও ভয় পায় না
শুকনো পাতার শব্দ- লঘু বাতাসে- গভীর বাতাসে- শুকনো পাতার
শুকনো পাতার শব্দ আজও যদি শুনতে চায় তারা
যদি একটি প্রাচীনতম দিক-নির্ণয়ের পেঁচা
অঘ্রানের জ্যোৎস্নায়
গোলাবাড়ির থেকে গোলাবাড়ির দিকে উড়ে
পৃথিবীর সমস্ত ধূসর চালের গন্ধের ভিতরেও কোনও কিছু খুঁজে না পায় আজ আর
তা হলে মৃত্তিকার নীচে আমার আত্মা তাদের সকলকে নিবৃত্ত অন্ধকারের কাছে ডেকে
শীতের রাতে নিবিড় শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকবে চির-কাল।