পাপস্বীকার

হে হৃদয়,
তুমি যদি কোনও চিনে-পরিব্রাজক হয়ে পৃথিবীতে নামো আর এক বার
(প্রব্রজ্যার দিন চিনে হয়তো এখনও ফুরোয় নি)
একটা চিনে-জামা প’রে মধ্য-এশিয়ার পথ দিয়ে চলেছ
হাতে দারুচিনির লাঠি;
হয়তো সারা-দিন মজুরদের সঙ্গে খাটতে হয়েছে-খানিকটা ভাত ও ফেনা কাঠিতে ঘুরিয়ে খেয়ে
তার পর মজুররা যখন ঘুমায় নক্ষত্রের রাতে বার হয়েছ আর এক বার
তখন তুমি বাংলার সেই কুঁড়েকে মনে রাখবে কি?
যেখানে অন্ধকার রাতে শঙ্খমালার সঙ্গে তুমি শুয়ে থাকতে
প্রেমকে মনে রাখবে কি?
কোথায় হেসেছ- কেঁদেছ
কোথায় স্থবির জননীকে পেয়ে বেদনা শিখেছ
কোথায় দরিদ্রতাকে পেয়ে;
কোথায় মানব-প্রধানদের স্বীকার করতে হয়েছে তোমার অন্নের জন্য;
সূর্যের আলোর সমস্ত সুন্দর দিনকে খণ্ড-খণ্ড ক’রে কেটে করাতের গুঁড়ো করে দিয়েছ
নক্ষত্রের রাতের দীর্ঘনারীশরীরকে বস্তির কেরোসিনকুপির ভিতর টেনে ফুরিয়ে ফেলেছ
তোমার অন্নের জন্য
কোথায় যৌবনের উত্তেজনায় স্থবিরের আশাকে আঘাত করেছ
বিধবার কাপড়কে জীর্ণ অসঙ্গত হয়ে ধীরে-ধীরে মৃত্যুর ছিদ্রে মিশে যেতে দেখেছ
পৃথিবীকে নতুন ক’রে গড়বার স্বপ্ন বন্ধুর জেনে বার-বার ছেড়ে দিয়েছ
কোনও দিন ভোরের আলো তোমার জন্য নীল সমুদ্র আনে নি
রাত্রি তোমাকে ডানার মতো তুলে নিতে এসে সমস্ত নগরের ইটের ভিতর চাপা প’ড়ে গেছে
কোনও দিন অরণ্যকে মৃত্তিকার নিচে গভীর শিকড়ের মানবিকতা ব’লে অনুভব করো নি তুমি-
মেঘের উপরে বিকেলের আলোয়, উল্কার ভিতর থেকে কে সে শুধায়-
গভীর তৃষ্ণায় সময়
জলকে তুমি ইন্দ্রজাল মনে করেছ
কিংবা ধানের রসকে
হৃদয়কে তুমি তৃষিত মনে করো নি কোনও দিন?
তাই মজুরদের কথা, মানুষের দুঃখ, পৃথিবীর যুদ্ধক্ষেত্র
তোমার কাছে ধোঁয়া বেদনা কামান ও মৃত্যু ব’লে মনে হয়েছে শুধু?
ভস্মস্তূপের ভিতর কোনও নতুনতর জীবনের আস্বাদ ব’লে মনে হয় নি?
আজও আমার তা মনে হয় না
আজও আমার মনে হয় না তা
নক্ষত্রের রজনীতে চীনের মরুভূমিতে ঘুরতে-ঘুরতে
তোমার কী মনে হয়, পরিব্রাজক?
আজও আমি সুন্দরীর শবের মতো দিনের আলোকে ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো
ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে আমার শরীর রক্ষা করি
আমার মানব-প্রধানের তৃপ্তির জন্য কাজ করি আমি সমস্ত দিন-
কোনও ঈশ্বর-প্রধানের জন্য নয়
কোনও সৌন্দর্য, কোনও প্রেম
কোনও প্রকৃতি রানির জন্য নয়
হে পরিব্রাজক।

আমার সমস্ত রাত্রি ব্যয়িত করি আমি সমস্ত দিনের দুর্ঘটনার অন্ধকারের উপর
বধির হৃদয়ে নিস্তব্ধ হয়ে ব’সে থেকে- কথা ভেবে- কথা ভেবে
গ্যাসের দুর্গন্ধে নারী ও শিশু ও রুগ্ন সাদা দাড়ির ভৌতিক আমোদ অনুভব ক’রে
মাথার উপরে বিস্ফোরক- দূরে কামানের শব্দে জীবনকে আড়াই হাত মাংস ব’লে স্বীকার ক’রে
ভোরের জন্য অপেক্ষা করি আমি
যখন সূর্য হৈ-হৈ ক’রে মশাল-হাতে উপস্থিত হবে
বিঘোষিত হবে যে, এ-পৃথিবী কাজের জন্য
কাজ শান্তির জন্য নয়, প্রেমের জন্য নয়
কাজ অন্নের জন্য।

হে পরিব্রাজক,
গোবি-মরুভূমির বালির ভিতর নক্ষত্রের রজনীতে হাঁটতে-হাঁটতে
জান না কি তুমি যে, কনফুশিয়াস কিছু নয়
বুদ্ধদেব কিছু নয়
শান্তি আমাদের কাছে- নির্বাণ আমাদের
আমাদের অপ্রধানদের মুমূর্ষ ও মৃত স্তূপের ভিড়ের ভিতর
যুগে-যুগে মানব-প্রধানদের কাছ থেকে অন্নের সংস্থান পাচ্ছি-যে আমরা
তথাগতর কাছ থেকে নয়।