পরিচায়ক

মাঝে-মাঝে মনে হয় এ-জীবন হংসীর মতন-
হয়তো-বা কোনও-এক কৃপণের ঘরে;
প্রভাতে সোনার ডিম রেখে যায় খড়ের ভিতরে;
পরিচিত বিস্ময়ের অনুভবে ক্রমে-ক্রমে দৃঢ় হয় গৃহস্থের মন।
তাই সে হংসীরে আর চায় না ক’ দুপুরে নদীর ঢালু জলে
নিজেকে বিম্বিত ক’রে; ক্রমে দূরে- দূরে
হয়তো-বা মিশে যাবে অশিষ্ট মুকুরে:
ছবির বইয়ের দেশে চির-কাল- ক্রূর মায়াবীর জাদুবলে।

তবুও হংসীই আভা;- হয়তো-বা পতঞ্জলি জানে।
সোনায় নিটোল করা ডিম তার বিমর্ষ প্রসব।
দুপুরে সূর্যের পানে বজ্রের মতন কলরব
কন্ঠে তুলে ভেসে যায় অমেয় জলের অভিযানে।
কেয়াফুল-স্নিগ্ধ হাওয়া স্থির তুলাদণ্ড প্রদক্ষিণ
ক’রে যায়;- লোকসমাগমহীন হিম কান্তারের পার
ক’রে না ক’ ভীতি আর মরণের অর্থ প্রত্যাহার:
তবুও হংসীর পাখা তুষারের কোলাহলে আঁধারে উড্ডীন।

তবুও হংসীর প্রিয় আলোকসামান্য সুর, শূন্যতার থেকে আমি ফেঁসে
এইখানে প্রান্তরের অন্ধকারে দাঁড়ায়েছি এসে;
মধ্য নিশীথের এই আসন্ন তারকাদের সঙ্গ ভালোবেসে।

মরখুটে ঘোড়া ওই ঘাস খায়,- ঘাড়ে তার ঘায়ের উপরে
বিনবিনে ডাঁশগুলো শিশিরের মতো শব্দ করে।
এই স্থান, হ্রদ আর, বরফের মতো সাদা ঘোড়াদের তরে
ছিল তবু এক দিন? র’বে তবু এক দিন? হে কালপুরুষ,
ধ্রুব, স্বাতী, শতভিষা,
উচ্ছৃঙ্খল প্রবাহের মতো যারা তাহাদের দিশা
স্থির করে কর্ণধার?- ভূতকে নিরস্ত করে প্রশান্ত সরিষা।

ভূপৃষ্ঠের অই দিকে- জানি আমি- আবার নতুন ব্যাবিলন
উঠেছে অনেক দূর;- শোনা যায় কর্নিশে সিংহের গর্জন।
হয়তো-বা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে এত রাতে ময়ূরবাহন:

এই দিকে বিকলাঙ্গ নদীটির থেকে পাঁচ-সাত ধনু দূরে
মানুষ এখনও নীল, আদিম সাপুড়ে:
রক্ত আর মৃত্যু ছাড়া কিছু পায় না ক’ তারা খনিজ, অমূল্য মাটি খুঁড়ে।

এই সব শেষ হয়ে যাবে তবু এক দিন;- হয়তো-বা ক্লান্ত ইতিহাস
শাণিত সাপের মতো অন্ধকারে নিজেকে করেছে প্রায় গ্রাস।
ক্রমে এক নিস্তব্ধতা: নীলাভ ঘাসের ফুলে সৃষ্টির বিন্যাস

আমাদের হৃদয়কে ক্রমেই নীরব হ’তে বলে।
যে-টেবিল শেষরাতে দোভাষীর- মাঝরাতে রাষ্ট্রভাষাভাষীর দখলে
সেই সব বহু ভাষা শিখে তবু তারকার সন্তপ্ত অনলে

হাতের আয়ুর রেখা আমাদের জ্বলে আজও ভৌতিক মুখের মতন;
মাথার সকল চুল হ’য়ে যায় ধূসর- ধূসরতম শণ;
লোষ্ট্র, আমি, জীব আর নক্ষত্রের অনাদি বিবর্ণ বিবরণ

বিদূষক বামনের মতো হেসে এক বার চায় শুধু হৃদয় জুড়াতে।
ফুরফুরে আগুনের থান তবু কাঁচিছাঁটা জামার মতন মুক্ত হাতে
তাহার নগ্নতা ঘিরে জ্ব’লে যায়- সে কোথাও পারে না দাঁড়াতে।

নীলিমাকে যত দূর শান্ত নির্মল মনে হয়
হয়তো-বা সে-রকম নেই তার মহানুভবতা।
মানুষ বিশেষ-কিছু চায় এই পৃথিবীতে এসে
অতীব গরিমাভরে ব’লে যায় কথা;

যেন কোনও ইন্দ্রধনু পেয়ে গেলে খুশি হ’তো মন।
পৃথিবীর ছোট-বড়ো দিনের ভিতর দিয়ে অবিরাম চ’লে
অনেক মুহূর্ত আমি এ-রকম মনোভাব করেছি পোষণ।

দেখেছি সে-সব দিনে নরকের আগুনের মতো অহরহ রক্তপাত;
সে-আগুন নিভে গেলে সে-রকম মহৎ আঁধার,
সে-আঁধারে দুহিতারা গেয়ে যায় নীলিমার গান;
উঠে আসে প্রভাতের গোধূলির রক্তচ্ছটা-রঞ্জিত ভাঁড়।

সে-আলোকে অরণ্যের সিংহকে ফিকে মরুভূমি মনে হয়;
মধ্য সমুদ্রের রোল- মনে হয়- দয়াপরবশ;
এরাও মহৎ- তবু মানুষের মহাপ্রতিভার মতো নয়।

আজ এই শতাব্দীতে পুনরায় সেই সব ভাস্বর আগুন
কাজ ক’রে যায় যদি মানুষ ও মনীষী ও বৈহাসিক নিয়ে-
সময়ের ইশারায় অগণন ছায়া-সৈনিকেরা
আগুনের দেয়ালকে প্রতিষ্ঠিত করে যদি উনুনের অতলে দাঁড়িয়ে,

দেওয়ালের ‘পরে যদি বানর, শেয়াল, শনি, শকুনের ছায়ার জীবন
জীবনকে টিটকারি দিয়ে যায় আগুনের রঙ আরও বিভাসিত হ’লে-
গর্ভাঙ্কে ও অঙ্কে কান কেটে-কেটে নাটকের হয় তবু শ্রুতিবিশোধন।