পৃথিবী সহসা যেন

পৃথিবী সহসা যেন উঠিল চকিত হয়ে মাইলের-পর-মাইল শস্যহীন খেতে
অন্তহীন আকাশের বিস্তৃত ব্যসনে শুয়ে পোখরাজ মাণিকের মতো
খচিত সূর্যকে পেয়ে- শীতের বিকালে আজ পাড়াগাঁ’র দেশে
শূন্যে ফুরাবার আগে আধােমরা বোলতা’ও এক বার চেয়ে দেখে উজ্জ্বল আবেশে
শানিত নদীর দিকে- সেইখানে দীপ যেন দহিতেছে জাফরান পিলসুজে- মৃত নিদাঘের
অথবা নিদাঘ এই আগুনের প্রতিভাকে কোনও দিন পায় নাই টের
মাঠে- খেতে- গোলাঘরে- হাঁসের পালকে- চিলে- উইয়ের ঢিবিতে
উচ্ছন্ন খড়ের উষ্ণ কর্কশ শরীরে- কালো পরিকীর্ণ মশা’র পুলকে
প্রদীপ জ্বলিতে আছে যেন এক গাঢ় মেধাবীর
প্রেম যারে জন্ম দিল চির-কাল- সকল মৃত্যুর পারে স্থির।

আসিছে শীতের রাত- তাই ভয় পেয়ে
চেয়ে দেখ অনর্গল হরিয়াল বঙ্কিম সঙ্কেতে গেল আকাশকে ছেড়ে
বাবলা’র বনের ও-পার দিয়ে- হয়তো-বা পারসিক সমুদ্রের দিকে
গোল মুণ্ড নিয়ে সূর্য পশ্চিমের সঙ্ঘারাম থেকে অনিমিখে
তাদের বিদায় দিল- যেন তারা আমাদের বিকেলের অরুন্তুদ নকশায় উচ্ছৃঙ্খল গণিকার হাত
আমাদের তরে তবু অভিজ্ঞ ধাতার মতো যেন তার গোপনীয় চোখের সম্পাত
প্রাচীন- প্রাচীনতম পৃথিবীর অভিমানহীন শীত নিয়মের রাশি
গোলাজাত করিতেছে ধীরে-ধীরে- নদীর নির্দিষ্ট জলে আদিধাতু জননীর মতন উদ্ভাসি

কাশেম যেতেছে চ’লে দু’টো মহিষের পিছে- কয়েকটা গোর ইতস্তত
তাহার গায়ের ঘ্রাণ- ঋতু-পরিবর্তনের দিনে পায়ের শিরার নিচে মৃত্তিকার মতো
সে-ও ঋতু- কয়েকটি গাভী ইতস্তত
ঋতু তারা;- তাহাদের রোমে নেমে কুয়াশার রমণীরা- গাহিতেছে পায়রার মতো কণ্ঠে গান
যদিও তারার দিকে বুনোহাঁস নিতে গেছে কুম্ভিলক-বৃত্তির সম্মান
বাবলা’র লাঠি তবু- খইয়ের মতন হিম ধূসর মুর্গি- বালিহাঁস
কাশেমের সাথে-সাথে চলিতেছে- যদিও অনেক রাতে মাথার উপরে ভেঙে পড়িবে আকাশ
জাপানি খেলনা থেকে রাঙা চোখে মঙ্গোলীয় কুটিরের ‘পরে
তবুও শীতের সন্ধ্যা অনাদির দাঁড়কাকদের সাথে উড়ে যায় খড় নিয়ে ঠোঁটে
(সারা-রাত গবলিন গোবি-মরুভূর খাদ্যে হেঁয়ালিতে চরে)
আমাদের মনীষীরা মোম হাতে নিয়ে তবু ব্যথা পায় সমাকীর্ণ রাত্রির হুঁচোটে
শীতের বিকেল তবু ধুলো, খড়, সজনে’র ফুলের ননি-মাখনে নিবিড় হয়ে ঝরে।

অথবা সোনালি খড় গাড়িতে বোঝাই ক’রে নিরুদ্দেশ জ্যোৎস্নার দিকে
যেতেছে সে;- বধির বলদ দু’টো বহু দিন পৃথিবীতে বেঁচে থেকে তবু সেই ফাঁকি
চিনে গেছে- পথ থেকে পথান্তর মড়াদের পরচুলা যদিও নিতেছে তারে ডাকি
তবুও সে কোনও দিন যাবে না ক’: বটের বিস্তৃত ঝুরি যেইখানে অশ্বত্থের পিঙ্গল সৌচিকে
টোকা দেয়- সেইখানে চিন্তা সব পরিধিবিহীন
হোয়াংহো নদীর তীরে যদিও অনেক মৃত চীন
প’ড়ে আছে- যদিও অনেক মৃত ভারতীয় কৃষকের রাশি
প’ড়ে র’বে অন্ধকারে
সোনালি খড়ের গাড়ি শীতের সন্ধ্যায় আজ তবু এক গোলার প্রত্যাশী

আসিছে শীতের রাত- তাই ভয় পেয়ে
চেয়ে দেখ অনর্গল হরিয়াল বঙ্কিম সঙ্কেতে গেল আকাশকে ছেড়ে
বাবলা’র বনের ও-পার দিয়ে- হয়তো-বা পারসিক সমুদ্রের দিকে
গোল মুণ্ড নিয়ে সূর্য পশ্চিমের সঙ্ঘারাম থেকে অনিমিখে
তাদের বিদায় দিল- যেন তারা আমাদের বিকেলের অরুন্তুদ নকশায় উচ্ছৃঙ্খল গণিকার হাত
আমাদের তরে তবু অভিজ্ঞ ধাতার মতো যেন তার গোপনীয় চোখের সম্পাত
প্রাচীন- প্রাচীনতম পৃথিবীর অভিমানহীন শীত নিয়মের রাশি
গোলাজাত করিতেছে ধীরে-ধীরে- নদীর নির্দিষ্ট জলে আদিধাতু জননীর মতন উদ্ভাসি

জানি আমি এই পথ শ্রেষ্ঠ কিংবা ফ্যালনা নয়- হয়তো মধ্যম নয়- কেবল কেন্দ্রিক
খড়ের ভিতরে ব’সে একা-একা অন্ধকারে হংসী পাড়ে ডিম
ধানের আঘ্রাণ আসে সারা-রাত মরাইয়ের থেকে জ্যোৎস্নায়
শনের চালের ‘পরে পনির-ধূসর পেঁচা কমনীয় মাংসল পায়ে
ধুপ ক’রে ব’সে পড়ে- ইঁদারার মতো স্তব্ধ চোখ তুলে- কোনও দিন মাঠের অন্তিম পাবে না সে খুঁজে
জ্যোৎস্না, হিম, যারা সব চ’লে গেছে সেই সব মৃতদের বোঝা
সারা-রাত যেই সব নক্ষত্রেরা ম্লান ডিম যেন কোনও পক্ষীপ্রসূতির
জ্যোৎস্নায় ক্ষিরুইয়ের ফল যেন পরম আয়ুর চেয়ে পুরানো নিবিড়-
পায় না সে কোমল চোখের গোল মণির মতন তারা- নাড়া যায়- দেয় না ক’ তাড়া
উড়ে যায় কঙ্কালের মতো কালো মসজিদের মেধাবী বুরুজে

কোথাও অরণ্য, দ্যাখো, নিপতিত হতে যেন ভালোবাসে মানুষের হাতে
তবুও গম্ভীর শান্তি শুকতারকার নিচে পারে সে ছড়াতে
কুড়ুলে বিদীর্ণ হয়ে জারুল- শাল্মলি- শিশু- জাম-
নির্জন নিহিত গন্ধে কাঠুরিয়া কৃষকের রুক্ষ প্রাণায়াম
পূর্ণ ক’রে দিয়ে যায়- যেন তারা ধীমান পুরুষগত লক্ষ যুগ ধ’রে
নদীর নির্মম জলে- অন্ধকারে- নিজেদের ছিন্ন দেহ দেখে
তাহাদের ক্ষোভ নাই- অবিরল মৃত্তিকার আবর্তনে- অনাদির সময়ঘড়িতে
বাক্যহীন চিন্তা হয়ে প্রান্তরের শীতে
লটায়ে থাকিতে পারে চির-কাল- কত দিন পথ দিয়ে যেতে-যেতে হেমন্তের রাত
আমারে এনেছে ডেকে পিপাসী কুড়ুলে কাটা এই সব তরুদের পাশে
কর্কশ শঙ্কিত দেহ- দীর্ঘ দেহ- দিকে-দিকে প’ড়ে আছে মাটির উপরে
ওজস্বী ঘ্রাণের মেঘে- মৃত্যু আর অগ্নি আর অঙ্গারের তরে
যেন এই সৃজনের শ্রেষ্ঠ স্বপ্ন: বৃদ্ধি নয়; গূঢ় উপচিকীর্ষার মতো
আদি শৈশবের কাছে একা এক জননীর নাসিকার মতন বিনত
শব্দহীন সুরে তারা কুয়াশার ঘোমটায় ঋদ্ধ চুল ঢেকে
কাটাতেছে আমাদের সব অনুসন্ধিৎসাকে স্নিগ্ধ ক’রে অঘ্রানের- পউষের- অবিরল নিশা
শীত-আকাশের রাতে আলোকিত লুব্ধকের পুলহের পুলস্ত্যের মতন মনীষা
এই সব তরুদেরও, এই সব পাখিদের, প্রান্তরের, মানুষের, ব্যূঢ় রাত্রির-
গলিবে অনেক ক্বাথ চালুনির ফাঁক দিয়ে সময়ের
উড়ে যাবে নৃমুণ্ডের ছিদ্র দিয়ে নানাবিধ জৈবিক সমীর-
তোমাদের মরণের লক্ষ বছরের পরে তবুও এমনই র’বে নিরাময়, স্থির।